বছর চব্বিশ বয়স তখন। 'স্কুটার' ছিল তার ছদ্মনাম। ঠান্ডা লড়াইয়ের মধ্যে ১৯৬৫ সালের জানুয়ারিতে উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তে অসামরিক অঞ্চলে (ডিমিলিটারাইজড জোন) টহল দিতে গিয়ে উধাও হয়ে যান মার্কিন সেনা সার্জেন্ট চালর্স রবার্ট জেনকিন্স।
পরে জানা যায়, উত্তর কোরিয়ায় ঢুকে পড়েছিলেন তিনি। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় জেনকিন্সকে ঘিরে আরও নানা নাটকীয় মুহূর্তের গল্প শোনা যায়। সোমবার জাপানে মারা গেছেন প্রাক্তন সেই মার্কিন সার্জেন্ট। বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর।
২০০৪ সালে তার বিচারের সময় জাপানে কোর্ট মার্শালে জেনকিন্স জানিয়েছিলেন, দক্ষিণ কোরিয়ায় ঝক্কির কাজ করতে মন চাইছিল না। ভিয়েতনামেও যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। তাই উত্তর কোরিয়ায় পালিয়ে যান তিনি। হাইস্কুলের চৌকাঠ মাড়াননি কোনও দিন। কান্নাভেজা গলায় সামরিক আদালতকে বলেছিলেন, সেটা ছিল বড়দিনের ছুটির সময়। খুব ঠান্ডা আর অন্ধকার। মদ খেতে শুরু করেছিলাম। এত মদ কখনও খাইনি।
জেনকিন্স তার বয়ানে জানিয়েছিলেন, ১০ বোতল বিয়ার শেষ করে তিনি অসামরিক অঞ্চলে টহলে থাকা নিজের বাহিনীর লোকজনকে বলেছিলেন, অপেক্ষা করতে। তার পরে নিচে নেমে রাস্তা দেখতে যান। এই সময়েই কোনও ভাবে উত্তর কোরিয়ার দিকে হেঁটে চলে যান। হাতে ছিল রাইফেল। তাতে আটকানো ছিল একটা সাদা টি শার্ট। জেনকিন্সের দাবি, তার লক্ষ্য ছিল রাশিয়া যাওয়া। আর উত্তর কোরিয়ায় যে তাকে রেখে দেওয়া হবে, সেটাও তিনি আশা করেননি। আমেরিকা অবশ্য বরাবরই তাকে 'বিশ্বাসঘাতক' মনে করে এসেছে।
উত্তর কোরিয়ায় থাকাকালীন জেনকিন্সকে সেখানকার সেনাদের ইংরেজি শেখাতে হতো। আর কখনও কখনও উত্তর কোরিয়া প্রশাসনের প্রচারধর্মী ফিল্মে মার্কিন গুপ্তচরের নেতিবাচক ভূমিকায় অভিনয় করানো হতো জেনকিন্সকে দিয়ে।
উত্তর কোরিয়াতেই নিজের চেয়ে ২০ বছরের ছোট জাপানি মহিলা এবং ছাত্রী হিতোমি সোগাকে বিয়ে করেন প্রাক্তন এই মার্কিন সার্জেন্ট। হিতোমিকে আবার ১৯৭৮ সালে অপহরণ করেছিল পিয়ংইয়ং। সেই সময়ে দেশের গুপ্তচরদের প্রশিক্ষণ দিতে এ ভাবেই মহিলাদের অপহরণ করত পিয়ংইয়ং প্রশাসন।
বিয়ে করার পরে জেনকিন্স পরিবারের সুরক্ষার কথা ভেবে আরও বেশি সিঁটিয়ে থাকতেন। উত্তর কোরিয়া তাকে যখন যা বলেছে, তিনি মেনেও নিয়েছেন। সোগা-জেনকিন্সের দুই কন্যা, মিকা এবং বৃন্দা। ২০০২ সালে জাপানে ফিরে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছিলেন সোগা। সে বছর অক্টোবরে এক সম্মেলনে উত্তর কোরিয়ার তৎকালীন নেতা কিম জং ইলের সঙ্গে জাপানি প্রধানমন্ত্রী জুনিচিরো কাইজুমির তেমন চুক্তিই হয়েছিল।
সোগা জাপানেই রয়ে যান। তার দু'বছর পরে জেনকিন্সও মেয়েদের নিয়ে জাপানে যান। সেখানেই তার কোর্ট মার্শাল হয়। আদতে নর্থ ক্যারোলাইনার বাসিন্দা জেনকিন্স সেই বিচারে উত্তর কোরিয়ায় পালিয়ে যাওয়া এবং শত্রুদের সাহায্য করার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হন। জাপানের মার্কিন সামরিক জেলে ২৫ দিনের জন্য রাখা হয়েছিল তাকে। ভালো আচরণের জন্য ছ'দিন আগে ছেড়েও দেওয়া হয় তাকে।
তারপর থেকে জাপানের দ্বীপ সাডোয় সোগার বাড়িতেই থাকতেন জেনকিন্স। বলতেন, জীবনের শেষ অধ্যায়ের প্রথম দিন শুরু হয়েছে। একটি স্যুভেনির শপ-এ বেশ জনপ্রিয় কর্মী ছিলেন তিনি। পর্যটকদের সঙ্গে ছবিও তুলতেন। সোমবার সাডোর সেই বাড়ির বাইরেই হঠাৎ পড়ে যান তিনি। হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
বিডি প্রতিদিন/১৩ ডিসেম্বর ২০১৭/আরাফাত