২০১৫ সালের নভেম্বর মাস! বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ। এরপর কলকাতা থেকে ট্রেনে করে নিজের মামি ও তার পরিবারের সাথে দিল্লি যাচ্ছিল কিশোরী সালিমা আখতার (বর্তমান বয়স ১৯)। যাত্রাপথেই মোরাদাবাদ রেল স্টেশনে পানি খাওয়ার জন্য নামে সালিমা কিন্তু হঠাৎ করেই সেই ট্রেন ছেড়ে দেয়। এরপর ট্রেনের পিছনে ছুট লাগিয়েও সেই ট্রেনে উঠতে ব্যর্থ হয় সে। একটা সময় প্ল্যাটফর্ম থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় সেই ট্রেন। মুহূর্তের মধ্যেই পরিবার হারা হয়ে যায় সালিমা।
তবে ভেঙে না পড়ে মুহূর্তের মধ্যেই স্টেশনের নিচে নেমে আসে ওই কিশোরী। একটি টেম্পো গাড়িতে উঠে মোরাদাবাদের পরবর্তী স্টেশনে নামার কথা বলে চালক। কিন্তু হায়! রোহিঙ্গা কিশোরীর ভাষা বুঝতে না পেরে তাকে স্থানীয় পুলিশ থানায় নিয়ে যায় চালক।
এরপর তার ঠাঁই হল হোমে। টানা প্রায় দুই বছর ধরে হোমে কাটানোর পর এক সপ্তাহ আগে গত ৫ জানুয়ারি দিল্লির শাহীন বাগে নিজের মামি, মামাতো ভাই-বোন সহ পরিবারের সাথে মিলিত হয় ওই রোহিঙ্গা কিশোরী সালিমা।
শাহীন বাগের মামির বাসায় বসে সেই ভয়ানক দিনটার কথা স্মরণ করে সংবাদমাধ্যমকে সালিমা আখতার জানায় ‘বাংলাদেশ থেকে আমরা সবেমাত্র ভারতে প্রবেশ করি এবং ট্রেনে করে দিল্লির উদ্যেশ্যে যাচ্ছিলাম। আমি হিন্দি ভাষার কিছুই জানতাম না। পানি খেতে নিচে নামার পরই ট্রেনটা ছেড়ে দিল। আমি তা ধরার ট্রেনের পিছনে কিছুটা ছুটলাম কিন্তু পারলাম না। এরপর স্টেশনের বাইরে এসে একটা টেম্পো গাড়ি নিলাম, গাড়ির চালককে বললাম আমাকে পরবর্তী স্টেশনে নামিয়ে দিতে কিন্তু চালক আমার ভাষা বুঝতে না পেরে আমাকে সহায়তা করার জন্য থানায় নিয়ে গেল কিন্তু সেখানে থানার কর্মকর্তারাও আমার ভাষা বুঝতে পারেনি। শেষে পুলিশের পক্ষ থেকে কলকাতায় কোন একজন ব্যক্তির সঙ্গে ফোনে আমার কথা বলিয়ে দেওয়া হয়। এরপর আমি বাংলায় কথা বলে পুরো ঘটনাটি জানাই’।
প্রথমে মোরাদাবাদের ‘রাজকিয়া মহিলা স্মরণালয়’ এ স্থান হয় সালিমা’র। সেখানে প্রায় ১ বছর তিন মাস কাটায় সে। প্রথম দিকে কেঁদে কেটেই সময় অতিবাহিত হয় পরিবারহীন নি:সঙ্গ সালিমার। সে জানায় ‘প্রথম দিকে হোমের কেউই আমার সঙ্গে কথা বলতো না এবং আমিও তাদের কথা বুঝতে পারতাম না। তারা তখন আকার ইঙ্গিতে আমাকে বোঝাতো। আমি তখন বুঝলাম যে আমাকে হিন্দি ভাষাটা রপ্ত করতে হবে, এরপর হোমেই হিন্দি ভাষা শেখার ক্লাসে ভর্তি হই’।
ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে হোমের অন্য কিশোরীদের সাথে। তাদের সাথে বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরে থাকাকালীন সময়ে নিজের শৈশবের সেই গল্প শোনাতো সালিমা। সকাল বেলায় হিন্দির ক্লাস, দুপুরে একটু খেলাধুলা, সন্ধ্যায় সেলাই মেশিনে কাজ করার পাশাপাশি হিন্দি সিনেমা দেখা পরে রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়া-হোমে এই ছিল তার দৈনন্দিন রুটিন।
সালিমা জানায় ‘কয়েকদিন আগেই আমার মায়ের টেলিফোন নম্বরটা মনে পড়ে, এরপর থেকেই প্রতিদিন হোমে একজন কর্মকর্তা আসতেন। তার সহায়তায় আমি মায়ের সঙ্গে কথা বলতাম। কিন্তু ভারতে অবস্থান করা আমার মামি ও তার পরিবারের কাছে আমার খবরটা কিভাবে পৌঁছে দেবেন-সেটা মায়ের জানা ছিল না। আসলে তিনি পড়াশোনা খুব বেশি জানতেন না। তিনি শুধু জানতেন যে আমি মোরাদাবাদের একটি জায়গায় থাকি।
এইমুহুর্তে দিল্লির শাহীনবাগ এলাকায় ছোট ঝুপড়িতে বসে মামি জান্নাতারা বেগম (৩৩) এবং মামাতো ভাই-বোন শাকের (২৪), লিজা আখতার (৯)-এর সঙ্গে রয়েছে সালিমা আখতার।
সেখানে বসেই সংবাদমাধ্যমকে জান্নাতারা জানান ‘সালিমা কিভাবে আমার কাছ থেকে হারিয়ে গেল সেই ঘটনা তার মাকে বলার মতো ভাষা আমার জানা ছিল না। ভারতের মতো এত বড় একটা দেশে কিভাবে সালিমাকে খুঁজে পাবো সেটাও আমাদের জানা ছিল না’।
গত বছরের জানুয়ারিতে আখতারকে উত্তরপ্রদেশের লখনউতে রাজকিয়া বাল গৃহ বালিকা হোমে স্থানান্তরিত করা হয় সালিমাকে। হোমের সুপার রীতা টামটা-যার জন্যই সালিমা ফের তার পরিবারের সাথে মিলিত হয়েছে-সেই রীতা জানান ‘আমি স্থানীয় ফরেনারস রেজিস্ট্রেশন কার্যালয়ে যাই, সেখানে গিয়েই জানতে পারি যে সালিমা বাংলাদেশি নয়, সে রোহিঙ্গা নাগরিক। এমনকি মেয়েটির পরিবার মিয়ানমার থেকে পালিয়ে গত কয়েক বছর বাংলাদেশে বসবাস করছিল-ওই কর্মকর্তা না বললে সেটাও আমার জানা ছিল না। এটা সত্যিই এক বিরল ঘটনা ছিল, আমরা ওই মেয়েটিকে বাংলাদেশেও ফেরত পাঠাতে পারি নি ’।
২০১৫ সালে শেষবার কথা হয় মা’এর সাথে। সেই থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত মায়ের সাথে কথা বলার সুযোগ পায় নি আখতার। যাই হোক এরই মধ্যে বাংলাদেশ থেকে লখনউয়ে অবস্থান করা নিজের মেয়ের সাথে কথা বলার পরই তার ফোন নম্বর দিল্লিতে বোনের কাছে পৌঁছে দেন।
জান্নাতারা বেগম জানান ‘ডিসেম্বরের মাঝামাঝি একটা সময় সালিমা ও আমি-দুইজনেই যখন একে অপরের সাথে কথা বললাম, দুই জনেই কেঁদে ফেলি। আমি সালিমা’র খোঁজ নিইনি বলে সে আমার ওপর রেগে ছিল। কিন্তু আমি তাকে কথা দিয়েছিলাম যে আমি শিগগির তার সঙ্গে দেখা করবো। অবশেষে গত ৫ জানুয়ারি দিল্লির শাহীন বাগের বাড়ি ফিরে আসে সালিমা’।
কিন্তু দীর্ঘদিন ঘরের বাইরে থাকায় নিজের মাতৃভাষা ‘রোহিঙ্গা’ ভাষাটাই আজ ভুলে গেছে সালিমা। সেখানে জায়গা করে নিয়েছে হিন্দি। কিন্তু মা রোহিঙ্গা ছাড়া আর কোন ভাষাই বোঝেন না। স্বভাবতই ফোনে বাংলাদেশে অবস্থান করা নিজের মা-কে ‘সালাম’ দেওয়ার পরই শব্দ হারিয়ে ফেলে সালিমা। কিন্তু তার বুকের ভিতর অনেক দু:খ, মান-অভিমান, বেদনা জমে আছে যেটা মায়ের সাথে ভাগ করে নিতে চায় সালিমা।
মোরাদাবাদ বা লখনউয়ের হোমে প্রিয়াঙ্কা, অনামিকা ও নিকিতার সঙ্গে সময় কাটানো, প্রিয় অভিনেতা ইরফান খান’এর হিন্দি ছবি বা দিন কয়েক আগে পিকনিক পার্টির গল্প মা’কে শোনাতে চায় সালিমা-এখন সেই দিনের অপেক্ষাতেই রয়েছে সে। যদিও হিন্দি ভাষাকে কোনদিনই ভুলতে চায় না ওই রোহিঙ্গা কিশোরী। কারণ সে মনে করে শুধুমাত্র ভাষার কারণেই এতটা সময় পরিবারহীন হয়ে বাইরে কাটাতে হয়েছে।
বিডিপ্রতিদিন/ ১৪ জানুয়ারি, ২০১৮/ ই জাহান