২৩ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:৪২

২০ মিনিটেই মৃত্যুপুরী

প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় রোমহর্ষক হামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক

২০ মিনিটেই মৃত্যুপুরী

সংগৃহীত ছবি

শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোয় তিনটি গির্জা ও তিনটি হোটেলে বিস্ফোরণের খবর আসে গত রবিবার স্থানীয় সময় সকাল পৌনে ৯টার দিকে। মাত্র ২০ মিনিটেই সৃষ্টি হয় এক মৃত্যুপুরীর। 

‘যিশুর পুনরুত্থান’ দিবস উদযাপনে গির্জাগুলোতে তখন চলছিল বিশেষ প্রার্থনা। এর মধ্যে ১৯ শতকের শুরুতে নির্মিত কোচিকাডের সেইন্ট অ্যান্থনির গির্জা শ্রীলঙ্কার একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। খ্রিস্টানদের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের কাছেও এটি একটি আকর্ষণীয় জায়গা। এ ছাড়া কাটুয়াপিতিয়ার সেইন্ট সেবাস্টিয়ানের চার্চ এবং বাত্তিকালোয়ার জিয়ন গির্জাও শ্রীলঙ্কায় ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের গুরুত্বপূর্ণ দুটি উপাসনালয়। 

বিবিসি জানায়, বিস্ফোরণে প্রতিটি গির্জাই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ছাদ উড়ে যায়। বিধ্বস্ত গির্জাগুলোর বেঞ্চ আর যিশুর ভাস্কর্যে রক্তের দাগ লেগে থাকতে দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আসা ছবি ও ভিডিওতে। এক প্রত্যক্ষদর্শী বিস্ফোরণের শব্দ শোনার পর দৌড়ে সেইন্ট অ্যান্থনির চার্চে গিয়ে মেঝেতে লাশ পড়ে থাকতে  দেখার কথা বলেছেন। 

কামাল নামের ওই ব্যক্তি বলেন, পৌনে ৯টার দিকে বিকট ওই বিস্ফোরণের শব্দ পান তিনি। এরপর লোকজনকে দৌড়ে বের হয়ে আসতে দেখেন। তারা চিৎকার করে অনেক লোকের মৃত্যুর কথা বলছিল। ‘আমরা দৌড়ে গির্জার ভিতরে গিয়ে লাশ পড়ে থাকতে দেখলাম। আমরা প্লাস্টিক দিয়ে সেগুলো ঢেকে দিলাম। এরপর পুলিশ এসে সবাইকে সেখান থেকে বের করে দিল।’

ইস্টার সানডের প্রার্থনার জন্য ওই গির্জায় পাঁচ শতাধিক লোক জড়ো হয়েছিল বলে জানিয়েছেন তিনি। প্রায় একই সময়ে বিস্ফোরণ হয় কলম্বোর শাংরি লা, সিনামন গ্র্যান্ড ও কিংসবুরি হোটেলে। প্রতিটি হোটেলের রেস্তোরাঁয় তখন সকালের নাস্তা সারতে আসা পর্যটকদের ভিড় ছিল। আর সেই পর্যটকরাই ছিল আত্মঘাতী হামলাকারীদের টার্গেট।

জুলিয়ান ইমানুয়েল : শ্রীলঙ্কায় বেড়ে ওঠা ৪৮ বছরের চিকিৎসক জুলিয়ান ইমানুয়েল পরিবার নিয়ে থাকেন যুক্তরাজ্যে। আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে কলম্বো এসে তারা উঠেছিলেন সিনামন গ্র্যান্ড হোটেলে। 

তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘বিকট বিস্ফোরণের সময় আমরা হোটেলের ঘরেই ছিলাম। বিস্ফোরণের ধাক্কায় আমাদের ঘর কেঁপে উঠল। পরে আমাদের হোটেলের লাউঞ্জে নিয়ে আসা হলো, পেছন দিক দিয়ে পালিয়ে যেতে বলা হলো। সেখানে আমরা কয়েকজন হতাহতকে দেখতে পেলাম, তাদের তখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।’ 

নিজের স্ত্রী-সন্তানদের দুরবস্থা নিয়ে দারুণ উদ্বিগ্ন এই চিকিৎসক আরও বলেন, ‘আমি জীবনের প্রথম ১৮ বছর শ্রীলঙ্কায় কাটিয়েছি। ওই সময়ে আমি গৃহযুদ্ধ ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা দেখেছি। কিন্তু আমার সন্তানরা; তাদের বয়স মাত্র ১১ ও ৭। তারা কখনো যুদ্ধ দেখেনি, এমনকি আমার স্ত্রীও না। তাদের জন্য এ এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। এটা সত্যিই খুব দুঃখের। আমি ভেবেছিলাল শ্রীলঙ্কা এসব লড়াই-সংঘাত পেছনে ফেলে এসেছে। কিন্তু এখন দুঃখ হলো, তা আবার ফিরে এসেছে।’

কিরণ আরাসারত্নম : সকালের নাস্তা খেতে যেতে সামান্য দেরি হওয়ায় প্রাণে বেঁচে যান লন্ডন বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক কিরণ আরাসারত্নম। তিনি বলেন, ‘এত জোরে শব্দ হয়েছিল যে আমি বজ্রপাত ভেবেছিলাম। সবাই আতঙ্কে ছোটাছুটি শুরু করেন। বেশির ভাগ মানুষ বুঝতে পারেননি আসলে কী হয়েছে। লোকজনের শার্টে রক্ত লেগে ছিল, ছোট একটা মেয়েকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলছিল। দেয়াল, মেঝে রক্তে ভেসে যাচ্ছিল।’ 

তিনি জানান, একের পর এক অ্যাম্বুলেন্সে করে হতাহতদের নেওয়া হচ্ছিল হাসপাতালে। স্বেচ্ছাসেবীদের আহ্বানে বহু মানুষ ততক্ষণে রক্ত দিতে ভিড় করেন ব্লাডব্যাংকে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পর দেহিওয়ালায় চিড়িয়াখানার কাছে ট্রপিক্যাল ইন হোটেলে সপ্তম এবং দেমাটাগোদা এলাকায় অষ্টম বিস্ফোরণের খবর আসে। দেহিওয়ালার ঘটনায় তিন পুলিশ সদস্য নিহত হন। কিরণ আরাসারত্নম একটি জরুরি আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নিয়ে বলেন, ‘আমি এখানে সর্বত্র বাতাসে রক্তের গন্ধ পাচ্ছি। রক্তাক্ত শিশুদের কাঁদতে দেখা ভীষণ ভয়ঙ্কর। আমি ৩০ বছর আগে শরণার্থী হিসেবে শ্রীলঙ্কা ছেড়ে ছিলাম। কখনো ভাবিনি আমাকে আবারও এসব দেখতে হবে।’

নাস্তার প্লেট হাতেই বিস্ফোরণ ঘটায় আত্মঘাতী : বিস্ফোরণ ঘটানোর আগে শ্রীলঙ্কার সিনামন গ্র্যান্ড হোটেলের ইস্টার সানডে ব্রেকফাস্ট বুফের লাইনে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন আত্মঘাতী এক হামলাকারী। হাতে প্লেট নিয়ে খাবারের অপেক্ষায় থাকার ভান করা এই ব্যক্তি শনিবার রাতে কলম্বোর এই পাঁচতারকা হোটেলটিতে উঠেছিলেন, তখন নিজের নাম মোহাম্মদ আজম মোহাম্মদ বলে জানিয়েছিলেন তিনি। 

সিনামন হোটেলের এক ম্যানেজার জানিয়েছেন, লাইনের সামনে আসার পর যখন তার প্লেটে খাবার দেওয়া হবে ঠিক তখনই হোটেলটির জনাকীর্ণ রেস্তোরাঁয় ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটান তিনি। বিস্ফোরক তার পিঠে বাঁধা ছিল। তিনি বলেন, ‘তখন সাড়ে ৮টা বাজে। ব্যস্ত সময়। অনেকগুলো পরিবার ছিল। লাইনের সামনে আসার পরই সে বিস্ফোরণ ঘটায়।’ 

ম্যানেজার আরও জানান, রবিবার সাপ্তাহিক ছুটি ও ইস্টার সানডের পর্ব থাকায় সিনামন গ্র্যান্ডের ট্যাপ্রোবেন রেস্তোরাঁয় তখন বহু লোকের ভিড় ছিল। তিনি উল্লেখ করেন, এই আত্মঘাতী শ্রীলঙ্কান ছিলেন। তার দেওয়া ঠিকানাটি ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে। ব্যবসার কাজে তিনি কলম্বো এসেছেন বলে হোটেল কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন। কলম্বোর অন্য দুই পাঁচতারকা হোটেল শাংরি-লা ও কিংসবারিতেও প্রায় একই সময় হামলা চালানো হয়। ওই সময়েই কলম্বোসহ তিনটি শহরের তিনটি গির্জায় ইস্টার সানডের প্রার্থনারত কয়েক হাজার লোকের মধ্য আরও তিনটি শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।

উসমান আলী : কলম্বোর বাসিন্দা উসমান আলী তার বাড়ির কাছের গির্জা থেকে লোকজনকে দৌড়ে বেরিয়ে যেতে দেখে বুঝেছিলেন- কিছু একটা খারাপ ঘটনা ঘটেছে। তার বাড়ির সামনের সড়কে অনেক অ্যাম্বুলেন্স ভিড় করতে দেখে কারণ বুঝতে তিনি দ্রুত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রবেশ করেন। সেখানে হামলার রক্তাক্ত ছবি ও ভিডিও দেখতে পান। সেখান আহতদের জন্য রক্ত দেওয়ার আবেদন করা হয়। তা দেখে তিনি ন্যাশনাল ব্লাড সেন্টারে যান, যেখানে প্রচুর মানুষ ভিড় করেছিলেন।

অল্পের জন্য রক্ষা : শ্রীলঙ্কার নেগোম্বোর সেন্ট সেবাস্টিয়ানস গির্জায় চলছিল ইস্টার সানডের বিশেষ উৎসব। অনেক ধর্মপ্রাণ মানুষ আগেভাগেই পৌঁছে যান সেখানে। দিলীপ ফার্নান্দো পরিবার নিয়ে ওই গির্জায় যান সকাল সাড়ে ৭টার দিকে। একটু দেরিই হয়ে যায় তাদের। পৌঁছে দেখেন বেশ ভিড়। এত মানুষ দেখে অন্য গির্জায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন দিলীপ। এতে সপরিবারে রক্ষা পেয়েছেন তিনি। সেখান থেকে চলে যাওয়ার অল্প সময় পরেই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এদিকে দিলীপ ও তার স্ত্রী চলে গেলেও তার পরিবারের অন্য সদস্যরা থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। 

এর মধ্যে দিলীপের দুই নাতনিও ছিলেন। তারা জায়গা না পেয়ে গির্জা বাইরে বসে অপেক্ষা করছিলেন। সে সময়ই এক তরুণকে তারা দেখতে পান। খুব ভারী একটা ব্যাগ নিয়ে গির্জার ভিতর ঢুকছিলেন। তাদের বিশ্বাস ওই তরুণই আত্মঘাতী এই হামলা চালান। শান্ত চেহারার ওই তরুণ যেতে যেতে দিলীপের এক নাতনির মাথায় হাত রাখেন। তিনি ভিতরে ঢোকার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিস্ফোরণ ঘটে। 

দিলীপ বলেন, ‘আমার নাতনিরা জানায়, তরুণটির বয়স ৩০ বছরের মতো হবে। খুব সাদাসিধে চেহারা। তার মধ্যে কোনো উত্তেজনা ছিল না, ভয়ও ছিল না। খুব শান্ত ছিল সে। ওই তরুণ ভিতরে ঢোকার পরপরই বিস্ফোরণ ঘটে।’ বিস্ফোরণের পর দিলীপের পরিবারের সদস্যরা দৌড়ে ওখান থেকে সরে আসেন। খুব ভয় পেয়েছিলেন সবাই। দিলীপকে ফোন দিয়ে ঘটনার কথা জানান।


বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর