১৫ নভেম্বর, ২০১৯ ১০:৪৮
খবর আনন্দবাজারের

লোকসান ১০ হাজার কোটি টাকা, কাশ্মীরে বাগানেই পচছে আপেল

অনলাইন ডেস্ক

লোকসান ১০ হাজার কোটি টাকা, কাশ্মীরে বাগানেই পচছে আপেল

সবুজ বাগানে রক্তের ছিটে! দূর থেকে প্রথমটায় তেমনই মনে হয়। না, রক্ত নয়। লাল রঙা আপেল মাটিতে এদিক ওদিক ছড়িয়ে। 

বাগান-মালিক আমির হুসেনের গলায় হতাশা। ‘‘রস জমলেই আপেল ভারী হয়ে গাছ থেকে পড়ে যায়। আর মাটিতে পড়লেই সব নষ্ট। ও আর বিক্রি হবে না। কিন্তু এ বছর ফল পাড়ারই লোক নেই। বিক্রিই বা কোথায়?” 

কাশ্মীরের আপেল বাগানে এ বার সত্যিই রক্তের দাগ। সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল হওয়ার পরে ১০০ দিন কেটে গিয়েছে। প্রথমে ছিল কারফিউ। কারফিউ শিথিল হতে জঙ্গিরা পোস্টার সেঁটে হুঁশিয়ারি দেয়। এ বছর আপেল ব্যবসা বন্ধ থাকবে। 

এ দিকে কাশ্মীরের ‘আপেল সিটি’ শোপিয়ানের গাছে গাছে লাল-সবুজ-সোনালি রঙের আপেল আসতে শুরু করেছে। আমির হুসেনের কপালে তখন থেকেই চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল। এ বার আপেল বিক্রি হবে তো? কিন্তু শোপিয়ানের আপেলে যে রক্তের ছিটে লাগবে, তা আমিরও ভাবেননি। 

আপেল চাষি মোহাম্মদ আশরাফ দারের হত্যা দিয়ে শুরু। এরপর শোপিয়ানেই রাজস্থানের ট্রাকচালক মোহাম্মদ শরিফ খান জঙ্গিদের হাতে খুন হন। তারপর ফের শোপিয়ানেই আপেল ব্যবসায়ীর উপরে হামলায় মারা যান পঞ্জাবের চরণজিৎ সিংহ। জঙ্গিরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ১৮ জন ভিন রাজ্যের শ্রমিককেও বন্দুকের সামনে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য কাশ্মীর ছেড়ে পালানোর হুঁশিয়ারি দিয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু পুলওয়ামায় ইটভাটার শ্রমিক সেন্থি কুমার বা মুর্শিদাবাদ থেকে কুলগামে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে যাওয়া পাঁচ বাঙালি শ্রমিক রক্ষা পাননি। ভিন রাজ্যের শ্রমিকরাই কাশ্মীরের বাগানে আপেল পাড়ার কাজ করেন। প্রাণের ভয়ে তারা কাশ্মীর ছাড়তে শুরু করায় আপেল পাড়ারই লোক নেই। তাই বউ-ছেলেকে নিয়ে আমির নিজেই হাত লাগিয়েছেন। 

প্রায় দু’খানা ফুটবল মাঠের সমান শোপিয়ানের বিশাল আপেল মান্ডি অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকেই গমগম করে। ভিন রাজ্যের ব্যবসায়ীরা আসতে শুরু করেন। শোপিয়ান ছাড়াও পুলওয়ামা, বিজবেহরা, সোপোর-এর আপেল এসে জমা হয় এই পাইকারি বাজারে। দিনে অন্তত ৩০০ ট্রাক আপেল রওনা হয় দেশ-বিদেশে। 

আর এখন? শুনশান মান্ডিতে ধুলো উড়ছে। ৫ আগস্টের পর থেকে এক ট্রাক আপেলও বের হয়নি। জঙ্গিদের ভয়ে আপেল চাষি বা ব্যবসায়ী কেউই মান্ডির পথ মাড়াচ্ছেন না। ৮০ টাকা কেজি দামের কাশ্মীরের সেরা আপেল ২৫-৩০ টাকা দরে বেচে দিতে হচ্ছে রাতের অন্ধকারে। আর এদিকে কারফিউ ওঠার পর থেকে সেনা-পুলিশের জওয়ানরা এসে চাপ দিচ্ছে, দিনের বেলা মান্ডিতে গিয়েই আপেল বেচতে হবে। দেখাতে হবে, সব স্বাভাবিক! 

মান্ডির সামনের দোকানে কাশ্মীরিদের প্রিয় নুন-চায়ে রুটি ভেজাচ্ছিলেন নাজির আহমেদ। আপেলের ব্যবসা করেন। গত বছরও কলকাতায় ‘এ-গ্রেড’ আপেল পাঠিয়েছেন। তার আফসোস, ‘‘কাশ্মীরে জঙ্গি আন্দোলন তো চলছে নব্বইয়ের দশক থেকে। ২০০৮, ২০১০-এও অশান্তি হয়েছে। ২০১৬ সালে বুরহান ওয়ানি মারা যাওয়ার পরেও সব বন্ধ ছিল। কিন্তু তখনও আপেল ব্যবসায় ধাক্কা লাগেনি।’’ 

শুধু আপেল নয়। ৩৭০ ধারা বাতিলের ধাক্কা লেগেছে পর্যটন থেকে হস্তশিল্প, ফলের রস থেকে তথ্যপ্রযুক্তি-কাশ্মীরের অর্থনীতির সব ক্ষেত্রেই। কাশ্মীর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি শেখ আশিকের হিসেবে, গত ১০০ দিনে ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। 

কাজ হারিয়েছে অন্তত ১ লাখ লোক। রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কাশ্মীর ট্রেডার্স অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স ফেডারেশনের সভাপতি মোহাম্মদ ইয়াসিন খানও এখন ঘরবন্দী। নাজিরের প্রশ্ন, ‘‘মোদিজি বলেছিলেন, ৩৭০ গেলে উন্নয়ন আসবে। এক দিকে জঙ্গি, অন্যদিকে সেনা জওয়ান-আপেল বাগান যে কুরুক্ষেত্র হয়ে উঠল!’’


বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর