সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের কুখ্যাত কারাগারে বন্দী ছিল লাখো মানুষ। সম্প্রতি বিদ্রোহীরা দামেস্ক দখল করার পর বাশার আল-আসাদ পালিয়ে চলে যান রাশিয়ায়। তার পতনের পরপরই বিভিন্ন কারাগার থেকে হাজারো মানুষকে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্ত হয়ে অনেকে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের কাছে যেভাবে নিজেদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন, তাতে মনে হয়েছে- এ যেন আরেক 'আয়নাঘর'। অনেকেই বলছেন- বাশার আল-আসাদের এটি একটি কসাইখানা।
‘আমার নাম ছিল নম্বর ১১০০’, বললেন হালা। নিজের নামে পরিচিত হতে এখনো ভয় পান তিনি। সিরিয়ার ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ সরকারের কারাগারগুলো থেকে মুক্তি পাওয়া হাজারো মানুষের একজন হালা।
হালা আল-জাজিরাকে বলেন, ২০১৯ সালে তাকে হামা শহরের একটি তল্লাশি চৌকি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসবাদে’র অভিযোগ আনা হয়েছিল। বাশার আল-আসাদের সরকার প্রায়ই সন্দেহভাজন সরকার বিরোধীদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ এনে তাদের গ্রেফতার করতো এবং পাশবিক নির্যাতন চালাতো। হালাকে গ্রেফতারের পর আলেপ্পোতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারাগারে বন্দী ছিলেন।
সিরিয়ার বিদ্রোহী বাহিনীগুলো গত ২৯ নভেম্বর আলেপ্পোর কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছানোর পর তিনিসহ অসংখ্য মানুষ ওই কারাগার থেকে মুক্ত হন।
বিদ্রোহী বাহিনী হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) কারাগার খুলে দেওয়ার কথা উল্লেখ করে হালা বলেন, ‘আমরা কখনো ভাবতেই পারিনি যে কখনো দিনের আলো দেখতে পাবো। বিশ্বাসই হচ্ছে না যে এটি সত্যি হয়েছে।’
মুক্তিদাতাদের সম্পর্কে হালা বলেন, ‘এই আনন্দ ছিল অপরিসীম; ইচ্ছা করছিল, তাদের জড়িয়ে ধরে চুমু খাই। আমরা চিৎকার করে তাদের ধন্য বলছিলাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি যখন আমার পরিবারের কাছে পৌঁছাই, তখন আনন্দের মাত্রা আরও বেড়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল, যেন আবার আমার জন্ম হয়েছে।’
এইচটিএস আলেপ্পোয় পৌঁছানোর পর বেশ কিছু অবকাঠামোর পাশাপাশি আলেপ্পোর প্রধান কারাগারটিও খুলে দেয়। এরপর বাহিনীটি আলেপ্পো থেকে দামেস্কের দিকে অগ্রসর হয়। তারা পুরো পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করে।
হালা তার কারাবন্দী জীবনের নির্মম স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমাকে আমার নাম ধরে ডাকা হতো না, স্রেফ নম্বর দিয়ে ডাকা হতো। তাই আমার নাম ছিল ১১০০।’
মানবাধিকার সংগঠন সিরিয়ান নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইটসের তথ্য অনুযায়ী, হালাসহ আল-আসাদের কারাগারে অন্তত ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬১৪ জন বন্দী ছিলেন।
সিরিয়ার কারাগারগুলো ছিল বাশার আল-আসাদের রেজিমকে টিকিয়ে রাখার অন্যতম মূল স্তম্ভ।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, ২০১৩ সালে সিরিয়া থেকে গোপনে বের করে আনা অনেক দেখিয়েছিল যে, সিরিয়ার সরকারি আটক কেন্দ্রে ব্যাপক নির্যাতন, অনাহার, প্রহার এবং রোগের ব্যাপক প্রমাণ আছে। একে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
হালা তার কারাবন্দী জীবনের স্মৃতি থেকে জানান, তারই সঙ্গে বন্দী ছিলেন এক কিশোরী। যিনি বাশার আল-আসাদ বাহিনীর নির্যাতনের কারণে মাত্র ১৬ বছর বয়সেই মারা যান। হালা বলেন, ওই তরুণীকে তার বিয়ের মাত্র দুই মাস পরে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পুলিশের অভিযোগ ছিল, ওই তরুণী, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী, এক বৃদ্ধা এবং দুজন চিকিৎসক বিপ্লবীদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছিল।
বাশার আল-আসাদের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া আরেক বন্দী ৪৯ বছর বয়সী সাফি আল-ইয়াসিন। তিনিও আলেপ্পোর কারাগার থেকেই মুক্তি পেয়েছেন। সাফি বলেন, ‘এটা যেন আমার জন্মদিনের মতো ছিল, যেন আমার জীবনের প্রথম দিন।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।’
সাফি আল-ইয়াসিন বলেন, গত ২৯ নভেম্বরের আগে কারাগারের কাছাকাছি গোলাগুলির শব্দ শুনে তারা সতর্ক হয়ে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘তারপর হঠাৎ শান্তি নেমে এল এবং আমরা বিজয়ী বিদ্রোহীদের গানের শব্দ শুনতে পেলাম। প্রায় ৫ হাজার বন্দী ছিল। আমরা জানালা-দরজা ভাঙতে শুরু করি বেরোনোর জন্য। এমনকি কারাগারের কর্মকর্তা ও প্রহরীরা সাধারণ পোশাকে আমাদের সঙ্গে বেরিয়ে যায়, যাতে বিদ্রোহীরা ধরতে না পারে।’
সাফি আল-ইয়াসিন বন্দী হওয়ার আগে উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার উপকূলীয় শহর বানিয়াসে নৌকা তৈরির কাজ করতেন। তিনি বলেন, ২০১১ সালে সিরিয়ার বিপ্লবের সময়কার এক বিক্ষোভে অংশগ্রহণের অভিযোগে ৩১ বছর সাজা হয়েছিল তাঁর। এরই মধ্যে তিনি সেই সাজার অর্ধেক পার করে ফেলেছেন। বিগত ১৪ বছর ধরে তিনি সিরিয়ার বিস্তৃত কারাগার নেটওয়ার্কের বিভিন্ন স্থানে ‘তীব্র শারীরিক নির্যাতন এবং বছরের পর বছর মানসিক যন্ত্রণার’ শিকার হয়েছেন।
সাফি বিভিন্ন কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল এবং প্রত্যেক কারাগারে আলাদা আলাদা পদ্ধতিতে নির্যাতন চালিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। তিনি সাইদিনায়ার কুখ্যাত কারাগারে এক বছর কাটিয়েছেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ২০১৭ সালে এই কারাগারকে ‘মানব কসাইখানা’ বলে আখ্যায়িত করেছিল। এরপর তাঁকে সুইদা এবং পরে আলেপ্পোতে স্থানান্তর করা হয়।
সাইদিনায়ার কারাগারে যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয় বলেও উল্লেখ করে সাফি আল-ইয়াসিন। তিনি বলেন, ‘আমার দেখা দৃশ্যগুলো মৃত্যুর পরও আমার স্মৃতি থেকে মুছে যাবে না।’ এসময় তিনি জানান, তার সামনেই এক বৃদ্ধকে নির্যাতন করে সারা শরীর রক্তাক্ত করে ফেলা হয়েছিল। সেই বৃদ্ধ নির্যাতনের ধকল সইতে না পেরে অবশেষে মারা যান।
আল-আসাদ পরিবারের ৫৪ বছরের শাসনের জাঁতাকল থেকে সিরিয়া মুক্তি পাওয়ার পর কারাগার থেকে মুক্তি পান মাহের। তিনি ভয়ে এখনো নিজের পুরো নাম প্রকাশ করতে চান না। ২০১৭ সালে ‘সন্ত্রাসে অর্থায়নের’ অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। এরপর বিনা বিচারে তাকে ৭ বছর বন্দী করে রাখা হয়। মাহের বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম, কর্তৃপক্ষ যেন আমাকে ভুলে গেছে। যেন আমি মানুষ নই, কেবলই একটি সংখ্যা।’
কারাগারের নির্মম ও ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে মাহের বলেন, ‘প্রতিটি মিনিট যেন মৃত্যুর কাছাকাছি ছিল, নির্যাতনের যে তীব্রতা ও নির্মম পদ্ধতি ছিল তা কোনো পশুও সহ্য করতে পারত না।’ মাহের জানান, তার বন্দীদশায় এর চেয়েও ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হলো, তিনি যখন দামেস্কের কুখ্যাত মেজ্জেহ কারাগারে এক আত্মীয়ের দেখা পান।
মেহের বলেন, ‘কারাগারের বাইরে হঠাৎ একটি বাস এল এবং কয়েকজন বন্দীকে ঠেলে আমার সেলে পাঠান হলো। তাদের মধ্যে একজনকে আমার ভগ্নিপতির মতো দেখাচ্ছিল। আমি প্রথমে দ্বিধায় ছিলাম এবং ভাবছিলাম, এটা তো আয়মান (মাহেরের ভগ্নিপতি) হতে পারে না, সে তো পা হারায়নি!’
মাহের তার সন্দেহ ঘোচাতে সেই বন্দীর কাছে যান এবং দেখতে পান, তার ভগ্নিপতি কেবল পা হারাননি, পাশাপাশি মানসিক ভারসাম্যও হারিয়েছেন। মাহের মূলত একটি ট্যাটু দেখে তার ভগ্নিপতিকে চিনতে পারেন।
মাহেরকে যেসব কারাগারে রাখা হয়েছিল মেজ্জেহ ছিল তার মধ্যে একটি। বছরের পর বছর বিনা বিচারে বন্দী থেকে নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর এক সময় তিনি ভাবতে শুরু করেন, তিনি কখনোই আর কারাগার থেকে বের হতে পারবেন না।
তবে দেরি হলেও মাহের, হালা এবং সাফির জীবনে ভালো কিছু ঘটেছে। তারা মুক্তি পেয়েছেন আল-আসাদ পরিবারের বন্দীশালা থেকে এবং একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবেই। মাহের বলেন, ‘কারাগারের কাছাকাছি গোলাগুলির শব্দ শুনে আমরা সবাই আল্লাহু আকবার স্লোগান দিতে শুরু করি। আমরা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে, এই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেবে।’
মাহের বলেন, ‘আমরা দরজা ভেঙে কারাগার থেকে বেরিয়ে এলাম, বিপ্লবীদের আলিঙ্গন করলাম, সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় সিজদাহ করলাম এবং নিরাপদে আমার বোনের বাড়িতে পৌঁছালাম। তিনি তাঁর পরিবার নিয়ে ইদলিবে থাকেন।’ সূত্র: আল-জাজিরা
বিডি প্রতিদিন/আরাফাত