মধ্যপ্রাচ্যের বাতাসে শুধুই বারুদের গন্ধ! যুদ্ধবিমানের গর্জনে ঘুম ভাঙছে সেখানকার বাসিন্দাদের। দিনভর যত্রতত্র চলছে ‘কার্পেট বম্বিং’। বোমাবর্ষণের অভিঘাতে মাঝেমধ্যেই কেঁপে উঠছে মাটি। অনুভূত হচ্ছে ভূকম্পন। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই উঠছে ‘ভূমিকম্প’ বোমার প্রসঙ্গ। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে শিউরে উঠছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।
বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের পর থেকেই সিরিয়ার উপর লাগাতার বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। এবার ইহুদি বিমান বাহিনীর বিরুদ্ধেই উঠল ‘ভূমিকম্প বোমা’ ব্যবহারের অভিযোগ। কম্পনের তীব্রতা রিখটার স্কেলে ধরা পড়েছে বলে জানিয়েছে সিরিয়া ভিত্তিক মানবাধিকার অবজারভেটরি অফ হিউম্যান রাইটস।
চলতি বছরের ১৫ ডিসেম্বর সিরিয়ার বন্দর শহর তার্তুসে ভয়ঙ্কর বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ)। সেই আক্রমণের পর ওই এলাকাসহ কেঁপে ওঠে আশপাশের মাটি। হামলার পর মুহূর্তের বিস্ফোরণের ছবি ইতোমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে বিরাট আকারের আগুনের গোলা আকাশে উঠতে দেখা যায়।
ইসরায়েলি বিমান হামলার জেরে তৈরি হওয়া ভূকম্পনের রিখটার স্কেলে তীব্রতা ছিল ৩.০। বন্দর শহর তার্তুস থেকে ৮২০ কিলোমিটার দূরে সিরিয়ার ইজনিক শহরে অবস্থিত তুরস্কের ম্যাগনেটোমিটার স্টেশন ওই কম্পন চিহ্নিত করে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে।
‘অপারেশন তার্তুস’-এ অবশ্য কী ধরনের বোমা বা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে, তা স্পষ্ট করেনি আইডিএফ। ফলে ‘ভূমিকম্প বোমা’র অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেক প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ। তাদের যুক্তি, যুদ্ধে ব্যবহৃত অতি শক্তিশালী বোমা বা ক্ষেপণাস্ত্রে ছুড়ে গোটা এলাকাটাকে ধূলোয় মিশিয়ে দিতে চাইছে ইসরায়েল। সেগুলির বিস্ফোরণে ভূমি কেঁপে ওঠা বিচিত্র ব্যাপার নয়।
পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১২ সালের পর সিরিয়ার তার্তুসে এত বড় বিমান হামলা চালায়নি ইসরায়েল। মূলত, আসাদ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা বিমান প্রতিরক্ষা ইউনিট, ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণ যোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের গুদাম, ২৩তম এয়ার ডিফেন্স ব্রিগেডের ঘাঁটিসহ যাবতীয় সামরিক এলাকাকে নিশানা করছে আইডিএফ। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় হামলাটি হয়েছে এয়ার ডিফেন্স ব্রিগেডের ঘাঁটিতে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের অনুমান, বারুদ এবং হাতিয়ার গুদামের উপর ইসরায়েলি বোমাবর্ষণের জেরে সেগুলিতে আগুন ধরে গিয়েছে। বিমান হামলার সঙ্গে সঙ্গেই সেখানেও বিস্ফোরণ শুরু হয়ে যায়। এই দুইয়ের অভিঘাতে মাটি কেঁপে উঠেছে। আর সেটাই ধরা পড়েছে রিখটার স্কেলে।
‘ভূমিকম্প বোমা’র ব্যবহার নিয়ে এক্স হ্যান্ডেলে (সাবেক টুইটার) একটি পোস্ট করেছেন, সিরিয়ার মানবাধিকার সংস্থায় কর্মরত রিচার্ড কার্দারো। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘১৫ ডিসেম্বর স্থানীয় সময় রাত ৯টা ৪৮ মিনিট নাগাদ তার্তুস সামরিক ঘাঁটিতে বিস্ফোরণ শুরু হয়। আর ঠিক রাত ১০টা নাগাদ তা ইজনিকের তুর্কি ম্যাগনেটোমিটার স্টেশনে ধরা পড়ে। অর্থাৎ, কম্পনের ঢেউগুলির ৮২০ কিলোমিটার পথ পেরোতে সময় লেগেছে মাত্র ১২ মিনিট।’
রিচার্ড আরও জানিয়েছেন, সাধারণ ভূমিকম্পের তুলনায় প্রায় ‘দ্বিগুণ দ্রুততায়’ ওই কম্পন অনুভূত হয়েছে। তার পোস্ট সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তেই দুনিয়া জুড়ে হইচই পড়ে যায়। উল্লেখ্য, তার্তুসে রাশিয়ার নৌঘাঁটি রয়েছে। সেখানে অবশ্য ইসরায়েল কোনও হামলা চালায়নি।
১৯৭১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের আমলে তার্তুসে নৌঘাঁটি তৈরি করে মস্কো। ভূমধ্যসাগরের ‘প্রবেশদ্বার’ হিসাবে এটিকে ব্যবহার করেন রুশ নাবিকেরা। ২০১৫ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে রাশিয়া। এরপর থেকেই ওই নৌঘাঁটি হাতিয়ার সরবরাহের জন্য ব্যবহৃত হয়ে এসেছে।
গত ৮ ডিসেম্বর বিদ্রোহীদের দখলে চলে যায় সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক। প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালান প্রেসিডেন্ট আসাদ। রাশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রতিবেশী দেশটির জমি কব্জা করছে ইসরায়েল। পাশাপাশি তেল আবিবের দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে যুদ্ধবিমান উড়ে গিয়ে সিরিয়ার বিভিন্ন শহরে লাগাতার হামলা করছে।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই বিমান হামলার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। বিদ্রোহীদের হাতে দামেস্কের পতনকে ইহুদি ভূমির পক্ষে নিরাপত্তার নিরিখে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। তার কথায়, ‘‘ইসরায়েলের উত্তর সীমান্তে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং নিরাপত্তার হুমকিকে নস্যাৎ করাই আমাদের এই হামলার লক্ষ্য।’’
বাশার আল-আসাদ প্রেসিডেন্ট পদে থাকাকালীন সিরিয়ার জমি ইরান মদতপুষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘হিজবুহল্লা’র হাতে হাতিয়ার তুলে দিতে যথেচ্ছ ব্যবহার হয়েছে বলে দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে তেল আবিব। দামেস্ক বিদ্রোহীদের দখলে চলে যাওয়ায় যাবতীয় অস্ত্র ফেলে রেখে পালিয়েছে আসাদ বাহিনী।
উল্লেখ্য, আসাদ সিরিয়া ছেড়ে পালাতেই দেশটির জমি হাতিয়ে নিতে ইহুদি ফৌজকে নির্দেশ দেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। সঙ্গে সঙ্গে গোলান মালভূমির (গোলান হাইটস্ নামে পরিচিত) বাফার জোন পেরিয়ে সিরিয়ার ভিতরে ঢুকতে শুরু করে আইডিএফ। পশ্চিম এশিয়ার দেশটির সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ‘মাউন্ট হেরমনে’-এর দখল নিয়েছে তারা। এই এলাকার মানচিত্রে বদল আসবে বলে হুমকির সুর শোনা গিয়েছে নেতানিয়াহুর গলায়।
ইসরায়েলের এই ধরনের পদক্ষেপগুলিকে ‘বিনা প্ররোচনায় আগ্রাসন’ বলে উল্লেখ করেছেন সিরিয়ার বর্তমান শাসক তথা বিদ্রোহী নেতা আল-সারা। এর ফলে পশ্চিম এশিয়ার পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে বলে বিবৃতি দিয়েছেন তিনি। অন্য দিকে আর এক বিদ্রোহী নেতা আবু মুহাম্মদ আল-জোলানি আবার বলেছেন, ‘‘ইহুদিরা অমূলক ভয় পাচ্ছে। আমরা সন্ত্রাসবাদের সমর্থক নই। ইসরায়েলের সঙ্গে আমরা কোনও সংঘাতে যেতে চাই না।’’
১৯৬৭ সালের বিখ্যাত ছয়দিনের যুদ্ধে গোলান মালভূমির দখল নিয়েছিল ইসরায়েল। পরবর্তী সময়ে এর কিছুটা দামেস্ককে ফিরিয়ে দেয় তেল আবিব। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া দুনিয়ার অধিকাংশ দেশই আংশিক দখলে থাকা গোলান মালভূমিকে ইসরায়েলের অংশ বলে স্বীকৃতি দেয়নি। ১৯৭৪ সালে সেখানে বাফার জোন তৈরি করে জাতিসংঘ। এর এক প্রান্তে সিরিয়া এবং অন্য প্রান্তটি ইসরায়েলের দখলে থাকবে বলে ঠিক হয়। ৫৭ বছর পর আবাারও একবার গোটা মালভূমিটি কব্জা করল আইডিএফ।
২০১১ সাল থেকে সিরিয়ায় চলছে গৃহযুদ্ধ। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী, এতে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন পাঁচ লাখের বেশি মানুষ। গৃহহীনের সংখ্যা কয়েক লাখ। আসাদ সরকারের পতনে সেই গৃহযুদ্ধ থামল বলেই মনে করা হয়েছিল। কিন্তু ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স দামেস্কের ২৫ মাইলের মধ্যে পৌঁছে যাওয়ায় নতুন করে অস্থিরতা তৈরির সম্ভাবনা আছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল