ভারতের উত্তরাখণ্ড ও হিমাচল প্রদেশে পাহাড়ি দুর্যোগ যেন এখন নিত্যসঙ্গী। মেঘভাঙা বৃষ্টি, হড়কা বান, ধস— বর্ষার মৌসুমে প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও মৃত্যু, ক্ষয়ক্ষতি, অচল হয়ে যাওয়া রাস্তা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন এর অন্যতম কারণ হলেও মানুষের অবাধ ‘উন্নয়ন’-ই প্রকৃত বিপর্যয় ডেকে আনছে পাহাড়ি রাজ্যগুলিতে।
গত দু’সপ্তাহেই উত্তরাখণ্ডের ধারালি ও হর্ষিল, জম্মু-কাশ্মীরের কিশ্তওয়ার ও কাঠুয়ায় একের পর এক মেঘভাঙা বৃষ্টি ও হড়কা বানে তছনছ হয়ে গেছে জনপদ। বহু মানুষ নিখোঁজ। ধ্বংসস্তূপের নীচে আটকে রয়েছেন আরও অনেকে। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, এত ঘন ঘন মেঘভাঙা বৃষ্টি ও হড়কা বান আগে দেখা যায়নি।
আবহাওয়াবিদরা জানাচ্ছেন, দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু এবং পশ্চিমি ঝঞ্ঝার যুগপৎ প্রভাবে অস্বাভাবিক বর্ষণ বাড়ছে। ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) আগেই সতর্ক করেছিল— হিমালয়-সংলগ্ন অঞ্চল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। উষ্ণায়নের জেরে হিমবাহ গলছে, হিমবাহসৃষ্ট হ্রদের সংখ্যা বেড়েছে ৪৮ শতাংশ। উত্তরাখণ্ডে ৫০০-রও বেশি হ্রদ এখন ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে। সামান্য ফাটলেই সৃষ্টি হতে পারে ভয়াবহ হড়কা বান।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিপর্যয়ের পেছনে মানুষের দায়ও কম নয়। পাহাড় কেটে নির্বিচারে রাস্তা, হোটেল, বাঁধ, টানেল নির্মাণে নড়বড়ে হচ্ছে পাহাড়ের মাটি। নদীর প্রাকৃতিক স্রোত আটকে দেওয়ায় অতিবৃষ্টির সময়ে বাঁধ ভেঙে পানি উপচে পড়ছে। পর্যটনের স্বার্থে সংবেদনশীল এলাকায় নির্মাণকাজ পাহাড়কে আরও দুর্বল করে তুলছে।
এ বছর হিমাচলে গড় বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি। শিমলায় ৬২ শতাংশ, মণ্ডীতে ৫৩ শতাংশ বেশি বর্ষণ হয়েছে। অতিবৃষ্টির কারণে মাটি ভিজে ধসপ্রবণতা বাড়ছে। শিমলা, কুলু, উনা-সহ একাধিক জেলা বারবার বিপর্যস্ত হচ্ছে। জীবন ও যাতায়াত অচল হয়ে পড়েছে।
সম্প্রতি ভারতের সুপ্রিম কোর্ট হিমাচলের পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আদালতের পর্যবেক্ষণ— কেবল প্রকৃতিকে দায়ী করা যাবে না, মানুষের হস্তক্ষেপই দুর্যোগকে ভয়ঙ্কর করছে। তাই ভবিষ্যতে কোনও উন্নয়নমূলক কাজের আগে ভূতত্ত্ববিদ, পরিবেশবিদ ও স্থানীয়দের মতামত নেওয়া জরুরি বলে মত শীর্ষ আদালতের।
হিমালয়ের বুক চিরে অযাচিত উন্নয়ন, সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের ছাপ— এই দ্বিমুখী আঘাতে হিমাচল ও উত্তরাখণ্ড এখন বিপর্যয়ের ‘হটস্পট’। প্রকৃতি বনাম উন্নয়নের লড়াইয়ে পাহাড়ের ভবিষ্যৎ কোন পথে যাবে, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল