রবিবার, ১৫ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা
বঙ্গবন্ধুকে সুরক্ষা দেওয়ার ব্যর্থতা

বাঙালির চিরকালের লজ্জা

আ স ম আবদুর রব

বাঙালির চিরকালের লজ্জা

বাঙালির জাতি-রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের অগ্নিশিখা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক ও আলোচনা অনুষ্ঠানসহ আমার অনেক ঐতিহাসিক স্মৃতি জড়িত রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও আন্দোলনের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর নাম সদা সর্বদা সর্বাগ্রে উচ্চারিত হবে। ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারণে, বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রশ্নে, স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলন সর্বোপরি অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পরিচালিত করার নীতি ও কৌশল গ্রহণ উপমহাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলন ইতিহাসে বিরল। স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে আমাদের মননে স্বাধীনতার বীজ বপন করে সশস্ত্র সংগ্রামের ধ্যান-ধারণায় অপরিমেয় তেজ ও অদম্য সাহস নিয়ে উজ্জীবিত করে শক্তি জুগিয়েছেন যিনি তিনি হচ্ছেন স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের অন্যতম সংগঠক সিরাজুল আলম খান। নির্বাচনকে আন্দোলনে রূপান্তর, স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন, স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, ঐতিহাসিক ৭ মার্চ এর মাধ্যমে অসহযোগ আন্দোলন এবং সশস্ত্র সংগ্রাম অনিবার্য করে তোলার ঘটনা বিংশ শতাব্দীতে অভাবনীয়।

তৎকালীন সাড়ে ৭ কোটি বাঙালি ইতিহাসের প্রয়োজনে জাতীয়তাবাদী চেতনার সংগ্রামে ধ্বংস, বিভীষিকা ও বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে একটি ভূখন্ডকে বাঙালির আত্মপরিচয় নির্মাণে বিশ্বের বুকে চিহ্নিত করতে পেরেছে। আত্মপরিচয় নির্মাণে রক্ত ঝরেছে, লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু এবং সম্ভ্রম হারানোর বেদনাসহ নজিরবিহীন ও বর্বরতম গণহত্যা বিশ্ববিবেককে বিদীর্ণ করে।

জনপ্রিয়তা বা ব্যক্তিত্ব-গুণে বা ইতিহাসের অনিবার্যতায় কেউ কেউ নিজের জীবদ্দশাতেই ইতিহাসের মূর্তপ্রতীক হয়ে ওঠেন। ভারতের মহাত্মা গান্ধী, ভিয়েতনামের হো চি মিন, কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো, আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, প্যালেস্টাইনের ইয়াসির আরাফাত এবং আরও অনেকে। বঙ্গবন্ধুও তেমনি। ইতিহাস নির্মাণকারীরা ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের যোজনা করেন, ইতিহাসকে এগিয়ে দেন ঐতিহাসিকতার প্রয়োজনে। জাতির উত্থান-পতনে, সুখে-দুঃখে বঙ্গবন্ধু এমনভাবে অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলেন যে সশস্ত্র সংগ্রামে অনুপস্থিত থাকার পরও তাঁকে কেন্দ্র করেই প্রবাসী সরকার গঠন করতে হয় এবং বঙ্গবন্ধুর নামে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। বাঙালি তার কয়েক শতাব্দীর সংস্কৃতি ও অর্থনীতি জাগরণের স্বপ্ন চরিতার্থ করার অনুপ্রেরণা খুঁজে পায় বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমে। সুতরাং বাঙালির ইতিহাস নির্মাণে অন্য সব সংগ্রামী ও জাতীয়তাবাদী নেতাদের অবদান থাকলেও বঙ্গবন্ধু সবাইকে ছাপিয়ে ইতিহাসে বাঙালির প্রতিভূ হয়ে ওঠেন- এই সত্যকে গ্রহণ করাই ন্যায়সঙ্গত।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কাপুরুষোচিত বর্বর হত্যাকান্ডের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে পৃথিবী থেকে সপরিবারে বিদায় করে দেওয়া হয়। এই দিবসকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে স্মৃতি প্রকাশ করার কোনো আত্মিক শক্তি আমি পাই না। বাঙালির চিরকালের লজ্জা জাতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে সুরক্ষা দিতে পারেনি। ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত অবহিত হওয়ার পরও তৎকালীন সরকার বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বিন্দুমাত্র উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এটাই বড় ধরনের ট্র্যাজেডি। এ জন্য তৎকালীন সরকার, দল বা দলের কাউকে অনুতপ্ত হতে দেখিনি আজ পর্যন্ত।

মুক্তি সংগ্রামের পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে এয়ারপোর্টে বরণ করে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে যাই তখন তো কল্পনাও করতে পারিনি এই অবিসংবাদিত নেতাকে এই বাংলার মাটিতে হত্যা করা হবে।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার সম্পর্ক এবং স্মৃতি দুই ভাগে পর্যালোচনা করার মতো। প্রথমটা হলো এক যুগের অধিক যা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত, আরেকটা হলো স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র কাঠামোর পরিবর্তন স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্রের স্বপ্ন, আন্দোলন-সংগ্রামের প্রশ্নে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, ডাকসুর ভিপি এবং নিউক্লিয়াসে সদস্য হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার অগণিত স্মৃতি রয়েছে, যদি সুযোগ পাই লিখিত আকারে প্রকাশ করে যাব। সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের পর অতি দ্রুত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাজনৈতিক প্রশ্নে আমাদের অবস্থান ভিন্ন হয়ে যায়। স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র কয়েক মাসের মাঝেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের রাজনৈতিক মতপার্থক্যে আমাদের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ১৯৭২ সালে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনকে কেন্দ্র করে সম্মেলনের আগের রাতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার দেখা হয়, কথা হয়। সেদিন ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারিনি জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আর কোনো দিন দেখা হবে না।

রাজনৈতিক বিরোধের পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আর দেখা হয়নি, কিন্তু একবার কথা হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে উত্তরবঙ্গে জাসদের একটা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে গেলে প্রচ- গুলিবর্ষণে আক্রান্ত হই এবং আমি আহত অবস্থায় তৎকালীন পিজি হাসপাতালে ভর্তি হই। রাতে হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে নার্স এসে বললেন, স্যার গণভবন থেকে আপনার টেলিফোন। আমি বুঝতেও পারছিলাম না গণভবনের টেলিফোনের মানে কী। আমি তাড়াতাড়ি নার্সের রুমে গিয়ে টেলিফোন ধরলাম। যতদূর মনে পড়ে তোফায়েল ভাই বললেন, রব সাহেব, লিডার কথা বলবেন। তখন আমি উপলব্ধি করলাম, বঙ্গবন্ধু কথা বলবেন। ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধুর সেই ভরাট দরদি কণ্ঠ, রব এখন কেমন আছ? আমি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বলে দিয়েছি তোমার সুচিকিৎসার জন্য। বহুদিন পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা। আমি আবেগাপ্লুত হয়ে গেলাম। আমার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। আমি শুধু বললাম, আপনি কেমন আছেন? সেদিনের সেই কথাই শেষ কথা। আর কোনো দিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা হয়নি। কিন্তু আমার কানে এখনো ধ্বনিত হয় বঙ্গবন্ধুর সেই আন্তরিকতা মিশ্রিত কণ্ঠ ‘রব...’।

আজ ভীষণভাবে মনে হয়, আর একবার যদি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হতো, আমাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে কথা বলতাম, তাঁর হত্যাকান্ডের সময় তাঁর দল ও সরকারের ভূমিকা নিয়ে কথা বলতাম, তাঁকে হত্যার মাধ্যমে আমরা যে কী অকৃতজ্ঞ জাতিতে পরিণত হয়েছি তা নিয়ে কথা বলতাম। কী লক্ষ্য নিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করা হয়েছিল আর এখন আমরা কোন অবস্থানে আছি, কীভাবে আমরা ভুল রাজনীতি ও অতি ক্ষমতার লোভে স্বাধীনতার লক্ষ্য, স্বপ্নকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছি তা নিয়ে কথা বলতাম।

লেখক : সভাপতি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর