সামনেই পঞ্চায়েত নির্বাচন। স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে চূড়ান্ত ব্যস্ততা। কিন্তু সেই ব্যস্ততাকে ছাপিয়ে পশ্চিমবঙ্গের প্রধান আলোচ্য বিষয় ভাগাড়ের পচা মাংস। পাড়ার চায়ের দোকান থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ-অফিস-আদালত সর্বত্রই এই আলোচনা। টেলিভিশন চ্যানেলগুলিতেও দিনভর চলছে নানা আলোচনা। পত্রিকাগুলিতেও পঞ্চায়েত নির্বাচনকে পিছনে ফেলে হেডলাইনে জায়গা করে নিয়েছে ‘পচা মাংস’। আর পচা মাংসের পর এবার কলকাতাবাসীর কাছে নতুন আতঙ্ক ‘টক্সোপ্লাজমোসিস’।
ভাগাড়ের পচা মাংসের জীবাণু এবার কলকাতাবাসীর শরীরে। ভাগাড়ের ঘটনা নিয়ে গোটা রাজ্য যখন উত্তাল তখন আতঙ্ক বাড়িয়ে সামনে এল এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য। সম্প্রতি কলকাতার যাদবপুর, টালিগঞ্জসহ একাধিক এলাকার বাসিন্দাদের শরীরে মিলেছে টক্সোপ্লাজমোসিস’এর অস্তিত্ব। শুধুমাত্র দক্ষিণ কলকাতাতেই অন্তত ১৪ জন এই রোগে আক্রান্ত বলে জানা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন টক্সোপ্লাজমোসিস হল এক ধরনের পরজীবী যা বিড়ালের মাংস, বিষ্ঠা বা মরা বিড়ালের থেকে এই পরজীবী ছড়ায়। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হল যাদের শরীরে এই রোগের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সঙ্গে বিড়ালের কোন সম্পর্ক নেই। তাদের বাড়িতে বিড়াল নেই, অফিসে বা রাস্তা-ঘাটেও বিড়ালের সংস্পর্শ নেই। তা হলে কলকাতাবাসীর শরীরে এই পরজীবীর হামলা কিভাবে হল? তবে কি ভাগাড়রের মরা বিড়ালের মাংস এই মানুষের পেটে গেছে? সেই সম্ভবনা কিন্তু একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
চিকিৎসক অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, ‘টক্সোপ্লাজমোসিস হল একটা পরজীবী, এটা সাধারণত বিড়ালের মধ্যে থাকে এবং বিড়ালের বিষ্ঠার মধ্যে বেশি পাওয়া যায়। আমরা ভাগাড় থেকে ছাগলের মাংস খেয়েছি, না কাক, বিড়াল, কুকুরের মাংস খেয়েছি-তা আমরা কেউ জানি না। হতে পারে সেখানে বিড়ালের লাশ পড়েছিল, বিড়ালের বিষ্ঠা হয়তো আলাদা করা যায়নি, কোনভাবে হয়তো সেটা মিশে গেছে’।
ইতিমধ্যেই এই রোগের প্রকোপ বাড়ছে হু হু করে। গত ছয় মাসে প্রায় তিন শতাধিক রোগী এসেছেন যাদের মধ্যে টক্সোপ্লাজমোসিসের অস্তিত্ব মিলেছে। এই রোগের উপসর্গ হল ঘাড়ের কাছে ফুলে যাওয়া, আচমকা জ্বর, গ্র্যান্ড ফোলা।
চিকিৎসকরা বলছেন, শিশু হোক বা পরিণত বয়স্ক-শরীরে টক্সোপ্লাজমোসিস বাসা বাধলে তার পরিণতি হতে পারে মারাত্মক। এর ফলে গর্ভবতীদের ক্ষেত্রে ভ্রুণ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। ক্যান্সারের রোগীর শরীরে এই পরজীবী প্রবেশ করলে মৃত্যু আরও তরান্বিত হয়। মানসিক ভারসাম্যও নষ্ট হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত কাবাবের মতো খাবার থেকেই এই রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। কারণ আগুনে ঝলসে তৈরি হয় কাবাব। ফলে তা পুরোপুরি জীবাণু মুক্ত করা অসম্ভব। তবে কি বহু জায়গায় চিকেন কাবাব বলে যা চালানো হয়েছিল তা ছিল বিড়ালের মাংসের কাবাব? এতদিন যারা তাড়িয়ে তাড়িয়ে কাবাব খেয়েছেন তাদের মনের ভিতরে ইতিমধ্যেই আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ১৯ এপ্রিল শুরুটা হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার বজবজ থেকে। ওই দিনই ভাগাড়ের মরা পশুর মাংস বাজারে সরবরাহের অভিযোগটি প্রথম আসে। ধীরে ধীরে প্রকাশ্যে এসেছে কিভাবে রাজ্যটির নানা প্রান্তে বছরের বছরের পর বছর ধরে চলছিল ভাগারের পচা মাংসের কারবার। ভাগাড় থেকে হিমঘর হয়ে সেই মাংস প্রক্রিয়াকরণের পর সেই পচা মাংস প্যাকেটজাত হয়ে চলে যেতো হোটেল, রেস্তোঁরা বা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে। তদন্তকারীদের দাবী কলকাতা ও আশপাশের ভাগাড় থেকে সংগ্রহীত মরা পশুর মাংস সীমান্ত পেরিয়ে পৌঁছে যেত বাংলাদেশ, নেপালেও।
আর প্রশাসন বা প্রভাবশালীদের মদদ ছাড়া দুই একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে যে দীর্ঘদিন ধরে এই র্যাকেট চালানো সম্ভব তা স্বীকার করে নিয়েছে ডান-বাম সব পক্ষ। বজবজের স্থানীয় বাসিন্দারা হাতে নাতে অভিযুক্তদের ধরে না ফেললে কি যে হতো তা ভাবলেই শিউরে উঠছে কলকাতাবাসী।
বিষয়টি নিয়ে রাজ্যটির সিপিআইএম সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র নিজেই জানিয়েছেন, ‘রাজ্য জুড়েই সব ক্ষেত্রেই একটা পচন শুরু হয়েছে। আর এর নেতৃত্ব দিচ্ছে রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল’।
বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছেন, ‘পুরো পশ্চিমবঙ্গটাই আসলে ভাগাড় হয়ে গেছে, আলাদা করে আর কি বলবো? প্রশাসনিক সহযোগিতা না থাকলে এই জিনিস কখনওই চলতে পারে না’।
বজবজের ঘটনা সামনে আসার পর কলকাতা পৌরসভার কর্মকর্তারা শহরের বেশ কয়েকটি হোটেল, রেস্তোঁরায় অভিযানও চালায়। কিন্তু কলকাতাবাসীর প্রশ্ন এই অভিযান কেন আরও আগে শুরু হল না? কেন নিয়মিত অভিযান চালানো হয় না?
কলকাতা পৌরসভার সাবেক মেয়র ও সিপিআইএম নেতা বিকাশ ভট্টাচার্য জানান, ‘সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব রাজ্য সরকার ও পৌরসভার। পৌরসভার দায়িত্ব হল খাদ্যের গুণমান বিচার করা, নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা। কিন্তু সেটা না হওয়ার জন্য দুই পক্ষই দায়ী’।
এতদিন ধরে মানুষ জেনে এসেছে ভাগাড় মানেই চিল, শকুনের আস্তানা। তবে ভাগাড়ের মাংস যে শুধু চিল, শকুনেরাই খায় এমনটা নয়। অন্তত ভাগাড়ের ঘটনায় যে তথ্য উঠে এসেছে তা শুনে অনেকেই এটাই বলছেন।
বিডি-প্রতিদিন/০১ মে, ২০১৮/মাহবুব