ভাগাড়ের মৃত পশুর মাংসের হদিশ মিলল এবার কলকাতার নিউ মার্কেট এলাকায়। ঐতিহ্যবাহী এই মার্কেট চত্ত্বরেই রয়েছে একাধিক ছোট-বড় হোটেল, রেস্তোঁরা। কিন্তু সেই হোটেল বা রেস্তোঁরায় পচা মাংসের সাথে ভাল মাংস মিশিয়ে কাবাব, চিকেন রোল, মটন রোল, মোমো, বিরিয়ানি, স্প্রিং রোল তৈরি করা হচ্ছে না তো? জিভে পানি আনা এই লোভনীয় পদের কথা শুনলেই এখন আঁতকে উঠছেন নিউমার্কেটে আসা দেশ-বিদেশের পর্যটকরা।
প্রতিদিন প্রায় কয়েক হাজার মানুষ আসেন এই নিউমার্কেট চত্ত্বরে। এই এলাকায় রয়েছে একাধিক আবাসিক হোটেলও। যেখানে প্রচুর বিদেশি পর্যটকেরাও আসেন, যার মধ্যে আবার বেশিরভাগটাই বাংলাদেশি। কিন্তু পচা মাংস দিয়ে খাবারের বিভিন্ন আইটেম হতে পারে এটা ভেবেই অবাক হয়ে যাচ্ছেন তারা সকলেই।
কক্সবাজার থেকে কলকাতায় বেড়াতে আসা নূর হাবিব তসরিম জানান, ‘আমরা বাংলাদেশ থেকে এখানে এসেছি বেড়ানোর জন্য। কিন্তু এখানে এসে শুনলাম যে মরা মুরগীর মাংস বিক্রি হয়, পচা গরুর মাংস বিক্রি হয়। এটা আমাদের জন্য সত্যিই আতঙ্কের। আমরা চাই কলকাতার মতো ঐতিহ্যবাহী ও পুরোনো শহরে এই জিনিসগুলো বন্ধ হোক। আমরা যারা বাংলাদেশ থেকে পর্যটক হিসাবে আসি, তারা এই আতঙ্ক থেকে মুক্ত হোক। আমরা আশা করি যে রাজ্য সরকার এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে’।
কলকাতায় ঘুরতে আসা দৈনিক আনন্দবাজারের ঢাকা প্রতিনিধি কুদ্দুস আফ্রাদ জানান ‘কলকাতার এই এলাকায় বাংলাদেশিরাই বেশি আসে। এখানে মাছ ও শাকশব্জি পাওয়া যায় না ফলে মাংসের দিকেই মানুষের বেশি ঝোঁক থাকে। কিন্তু কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকায় ও টেলিভিশনে এই খবরটি দেখে আমরা যথেষ্টই আতঙ্কিত। সবচেয়ে খারাপ লাগে যে কলকাতার মতো পুরানো শহরে এই ধরনের একটা ঘটনা ঘটছে। এই খাবার খেয়ে মানুষ অসুস্থ হোক, আতঙ্কিত হোক, আমরা এটা চাই না। রাজ্য সরকারের উচিত বিষয়টি যত্ন সহকারে দেখা’।
ভাগাড়ের ঘটনার প্রধান মাথা বিশ্বনাথ ঘোড়ই ওরফে মাংস বিশুকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তদন্তকারীরা জানতে পেরেছে যে, তার হিমঘর থেকে কলকাতা ছাড়াও উত্তরবঙ্গে বিভিন্ন জায়গাতেও ভাগাড়ের মাংস পাঠানো হতো। জেরায় সে নিজেই স্বীকার করে নিয়েছে বিভিন্ন ভাগাড় থেকে মরা মুরগীসহ যে কোন মরা পশুর মাংস চলে আসতো তার হিমঘরে। এরপর সেখানে প্রক্রিয়াকরণের পর প্যাকেটজাত মাংস বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা হতো।
হিমঘরের মাংসের প্রায় ৪০ শতাংশ কলকাতার নিউ মার্কেটে পাঠানো হত বলেও জানিয়েছে বিশু। সেখান থেকে বিভিন্ন লিঙ্কম্যানের হাত দিয়ে রেস্তোঁরা, হোটেল ও ফাস্টফুডের দোকানে চলে যেত।
সূত্রের খবর, রাজাবাজারের হিমঘর থেকে ভাগাড়ের মাংস সরাসরি নিউ মার্কেটে চলে যেত। প্রতিদিন রাতে এসি গাড়িতে করে নিয়ে যেত বিশ্বনাথের ঘনিষ্ঠ সঙ্গীরা। নিউ মার্কেটের পাইকারি বাজারের চার থেকে পাঁচজন সেই মাংস নিত। তারপর কয়েক হাত ঘুরে তা চলে যেত রেস্তোঁরা ও হোটেলে। অনেক প্যাটিসের কারখানাতেও নাকি সেই মাংসিত নিয়মিত সরবরাহ করা হতো।
বিশ্বনাথকে জেরার পরই তদন্তকারী দলের সদস্যরা নিউ মার্কেটের বেশ কয়েকটি দোকানে অভিযান চালায়। যদিও বিষয়টি টের পেয়েই ব্যবসায়ীদের অনেকেই আগে থেকেই গা ঢাকা দেয়। ফলে খালি হাতে ফিরে আসতে হয় তদন্তকারী কর্মকর্তাদের। কলকাতা পুরসভা ও নিউমার্কেট থানার নাকের ডগায় কিভাবে দিনের পর দিন ঐতিহ্যবাহী মার্কেটে এই কারবার চলতো তা নিয়েই পর্যটক থেকে শুরু করে সকলেই হতবাক।
পচা মাংসের খবরটি সামনে আসার পর থেকে খাদ্য তালিকায় প্রাধান্য পাচ্ছে মাছ বা ভেজিটেবলস। ডাল, ভাজি, তরকারি, মাছ আর চাটনি দিয়েই সকাল-দুপুর বা রাতের খাবারের থালা সাজাচ্ছেন কলকাতা শহরবাসী। বাইরে থেকে এই শহরে যারা আসছেন তাদেরও প্রথম পছন্দ এখন ভেজিটেবলস।
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে কলকাতায় আসা রিজারুল আলম জানান, ‘এই খবরটা মোটেও সুখকর নয়। এটা শোনার পর থেকে মানসিক ভাবেও খুব খারাপ লাগছে। খেতেও ভাল লাগছে না, ঘুরতেও ভাল লাগছে না। মাংস বাদ দিয়ে মাছ, মুরগীর মাংস আর শব্জি দিয়ে খাবার খাচ্ছি’।
ভাগাড়ের পচা মাংসের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও। এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। মমতা বলেন ‘সাম্প্রতিক কালে কিছু ঘটনার জেরে অনেকে মাংস খাচ্ছেন না। ওসব ঘটনা ঠেকাতে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গড়া হয়েছে। ওরা ফুলপ্রস্নপ মেকানিজম তৈরি করবে। সেই মেকানিজম চালু হলে মানুষ নিশ্চিন্তে মাংস খেতে পারবেন’।
বিশুকে জেরা করে পচা মাংসের কারবারে আরও কয়েকজন মাথাকে খোঁজা হচ্ছে। তদন্তকারীদের সন্দেহ কলকাতার নিউ মার্কেট এলাকায় একাধিক মাংস ব্যবসায়ী মরা পশুর মাংস পাচারে জড়িত রয়েছেন। বিশুর আগে এই ঘটনায় আটক একাধিক অভিযুক্তকে জেরা করে তদন্তের আরও গভীরে যেতে চাইছে তদন্তকারীরা কর্মকর্তারা।
এদিকে বৃহস্পতিবার সকালেও নিউমার্কেট এলাকায় জ্যান্ত মুরগীর সাথেই অনেক মৃত মুরগীকেও মাংস ব্যবসায়ীদের কাছে সরবরাহ করতে দেখা যায়। খবর পেয়ে কলকাতা পুরসভার কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে এসে মৃত মুরগীগুলিকে নিয়ে যান।
উল্লেখ্য গত ১৯ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার বজবজে ভাগাড়ের মরা পশুর মাংস বাজারে সরবরাহের অভিযোগটি প্রথম আসে। ধীরে ধীরে প্রকাশ্যে এসেছে কিভাবে রাজ্যটির নানা প্রান্তে মাসের পর মাস ধরে চলছিল ভাগারের পচা মাংসের কারবার।
বিডি প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ সিফাত তাফসীর