দক্ষিণ কলকাতার হার্দিক জৈন লকডাউনের পর এই প্রথম সিনেমা হলে গেলেন। স্ত্রীর জন্মদিন উপলক্ষে তিনি মাল্টিপ্লেক্সে বড় পর্দার সামনে জন্মদিনের পার্টির আয়োজন করেছিলেন। আত্মীয়-স্বজন কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন। কেক কাটার পাশাপাশি হার্দিকের স্ত্রী আইনক্সের ভিডিও জকির কাছ থেকে বার্থডে মেসেজ পেয়ে খুব আশ্চর্য হলেন।
তিনি বলেন, ‘‘বড় পর্দায় পুরোনো সিনেমা দেখার মধ্য দিয়ে আমার আলাদা অভিজ্ঞতা হয়েছে। জন্মদিনে একেবারে অন্যরকম অনুভূতি।' একই অভিজ্ঞতা জিতেন্দ্র ভাটিয়ার। তিনি বিবাহবার্ষিকী উদযাপনের জন্য বেছে নিয়েছিলেন সল্টলেকের কার্নিভাল সিনেমাকে। চলচ্চিত্রের পাশাপাশি রূপালি পর্দায় তাদের একান্ত ব্যক্তিগত প্রাক-বিবাহ ভিডিও দেখানো হয়। তা দেখে সস্ত্রীক ভাটিয়ার মতো অনেক দম্পতি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠছেন। যেমন নিখিল ভেঙ্কটেশ ও সাই মনভিতা। তাদের বিবাহ সংক্রান্ত ভিডিও বড় পর্দায় দেখে আত্মীয়রাও খুব খুশি।
এমন অনেকে জন্মদিন বা বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালনের জন্য বেছে নিচ্ছেন কলকাতার খ্যাতনামা মাল্টিপ্লেক্সগুলোকে। পিভিআর, আইনক্স বা কার্নিভাল এভাবেই নতুন বিনোদনের সুযোগ এনে দিচ্ছে দর্শকের সামনে। দামও একেবারে নাগালের মধ্যে। এক হাজার ৯৯৯ টাকা দিলেই পিভিআর প্রাইভেট স্ক্রিনিংয়ের জন্য বুক করা যেতে পারে। অন্যদিকে আইনক্সে দুই হাজার ৯৯৯ টাকা খরচ করলে ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া পাওয়া যাবে। কার্নিভাল-এর ক্ষেত্রে এই খরচ এক হাজার ৫০০ থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত। সিনেমা দেখার পাশাপাশি অতিরিক্ত টাকার বিনিময়ে খাওয়াদাওয়ারও যথেষ্ট আয়োজন রয়েছে।
আইনক্স-এর মার্কেটিং অফিসার সৌরভ বর্মা বলেন, ‘‘বিভিন্ন জায়গায় আপনি নানা রকম ট্রেন্ড দেখবেন। কোথাও রজনীকান্তের ছবি দেখতে দেখতে একজন তার প্রেমিকাকে বিয়ের প্রস্তাব দিল। আবার দক্ষিণ কলকাতায় পরিবারের অনেকে পুজোর উৎসবে প্রাইভেট স্ক্রিনিং উপলক্ষে জমায়েত করে আনন্দে মাতছেন।’’
মাল্টিপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ এই প্রাইভেট স্ক্রিনিং নিয়ে আশাবাদী। নভেম্বরে বুকিং শুরু হওয়ার পরপরই প্রতি সপ্তাহে বেশ ভালো বুকিং হচ্ছে। কার্নিভাল সিনেমার কুণাল সাহানি বলেন, ‘‘আনলক পিরিয়ডে যখন হলগুলি নতুন করে খুলতে শুরু করল, তখনই এই ট্রেন্ডটা চোখে পড়েছিল। নতুন বাংলা ছবির বুকিংয়ের ক্ষেত্রে ১৮-২০ জন একসঙ্গে ব্যক্তিগত বুকিং করেছিলেন।’’
সন্দেহ নেই যে, এই প্রাইভেট স্ক্রিনিং সিনেমাপ্রেমীদের কাছে বিনোদনের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। যথাযথ স্যানিটাইজেশনের সঙ্গে দূরত্ববিধি বজায় রেখে জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী বা যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠান এভাবে উদযাপন করা কার্যত লকডাউনের ফসল।
নতুন বাংলা ছবি আসার পরেও হলগুলোর লোকসান দূর হয়নি। যেখানে প্রিয়া, প্রাচী, অশোকা, ইন্দিরা, মেনকার মতো সিঙ্গল স্ক্রিন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেখানে এই প্রাইভেট স্ক্রিনিং কি সিনেমা ব্যবসার হাল ফেরাতে সাহায্য করবে?
চলচ্চিত্র সমালোচক, সাংবাদিক নির্মল ধর বলেন, ‘আমাদের দেশের মানুষের যা অর্থনৈতিক সামর্থ্য তাতে তিন বা পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে হল ভাড়া করা সম্ভব? আর তাতে পাবলিক বিনোদন বলে কিছু হচ্ছে না। মাল্টিপ্লেক্সের সঙ্গে শপিংমল আছে। কিন্তু সিঙ্গল স্ক্রিনের ক্ষেত্রে সেটা নেই। সিঙ্গল স্ক্রিনে এমন প্রাইভেট স্ক্রিনিং করা সহজ নয়, আর তাতে নিয়মিতভাবে দর্শকও পাওয়া যাবে না।’’
প্রাইভেট স্ক্রিনিং সিনেমা হলের দশা ফেরানোর সঠিক সমাধান বলে মনে করেন না নির্মল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডিজের অধ্যাপক মানস ঘোষ বলেন, ‘‘কলকাতার বিত্তশালীদের জীবন এখন অনেকটা সঞ্জয় লীলা বনসালির ছবির মতো হয়ে গেছে। তাই এই প্রাইভেট স্ক্রিনিংয়ে মানুষ উৎসাহ পাচ্ছে।’’
কিন্তু তাতে আদতে সিনেমার কিছু ভালো হবে না বলেই অধ্যাপকের মত। তিনি বলেন, ‘‘ওয়েব সিরিজের জন্য অডিটোরিয়ামে যাওয়ার প্রবণতা কমে গেছে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। সামগ্রিকভাবে বাজারের অনেক ক্ষতি হয়েছে। সিনেমা হলের যে গণতান্ত্রিক পরিসর ছিল, তা প্রাইভেট স্ক্রিনিংয়ের ফলে ব্যাহত হবে।’’
অধ্যাপকের বক্তব্য, ‘‘বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিপরীতেই ছিল সিনেমা হলের অবস্থান। সিনেমা হলে একসঙ্গে বসে সব ধর্ম-বর্ণ-জাতি-লিঙ্গ নির্বিশেষে মানুষ ছবি দেখতে পারে। প্রাইভেট স্ক্রিনিংয়ের এই ট্রেন্ড বিভাজন তৈরি করবে বলেই আমার ধারণা।’’
বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ আহমেদ