ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো মসৃণ করতে মৈত্রী এক্সপ্রেস, বন্ধন এক্সপ্রেসের পর এবার চালু হল মিতালী এক্সপ্রেস। বুধবার স্থানীয় সময় সকাল ৯.৪৩ মিনিটে দিল্লির রেলওয়ে বোর্ড কনফারেন্স হল থেকে ট্রেনটির ভার্চুয়ালি ফ্ল্যাগ অফ করেন ভারতের রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব এবং বাংলাদেশের রেলমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন। এসময় দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশ হাইকমিশনের মোহাম্মদ ইমরান, বাংলাদেশ রেলওয়ে বোর্ড ( অপারেশন) এডিজি সরদার সাহদাত আলী, ভারতীয় রেলওয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান বি.কে ত্রিপাঠী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ফ্ল্যাগ অফের পরই নিশ্চিদ্র নিরাপত্তার ঘেরাটোপে এই ট্রেনটি শিলিগুড়ির নিউ জলপাইগুড়ি (NJP) রেলস্টেশন থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। এসময় এনজেপি রেল স্টেশনে উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় রেলের কর্মকর্তা, সাংবাদিক এবং সাধারণ মানুষ। তাদের অনেককেই মিতালী এক্সপ্রেসের ছবি ও সেলফি তুলতে দেখা যায়। যাত্রার প্রথম দিন ১২ জন যাত্রী নিয়ে এই ট্রেনটি ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়। এ ব্যাপারে রেলওয়ে কর্মকর্তা অলক কুমার জানান, প্রথম দিন তাই অনেকেই বিষয়টি জানে না। তবে আগামী দিনে যাত্রী সংখ্যা আরো বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
অন্যদিকে দিল্লিতে ভারতীয় রেলমন্ত্রী বৈষ্ণব বলেন, ভারতীয় রেলের কাছে খুবই একটা খুশির মুহূর্ত। ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে যে সম্পর্ক, তা দাঁড়িয়ে রয়েছে আমাদের দুই দেশের মধ্যে ভাগাভাগি করা ঐতিহ্য, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ। বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক সর্বোচ্চ পর্যায়ে বিরাজ করছে। সে ক্ষেত্রে এই এক্সপ্রেস ট্রেনটি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদারের ক্ষেত্রে মাইলস্টোন হয়ে দাঁড়াবে। এটি এমন একটি সময়ে এই ট্রেন সার্ভিস চালু হলো যখন একদিকে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি পালন করছে, অন্যদিকে ভারত স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি পালন করছে। এমন এক পরিস্থিতিতে রেলসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও মজবুত করতে বিভিন্ন রকমের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে রেলওয়ে থেকে আমরা অনেক কিছু শিখেছি, আমাদের সীমিত ক্ষমতার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশকে কিছু সহায়তা করার চেষ্টা হচ্ছে। একটি উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, গত কয়েক বছর আগেই দুই দেশের মধ্যে ৭০০ মালবাহী ট্রেন যাতায়াত করত, সেখানে সেই সংখ্যা বৃদ্ধি করে প্রায় ১৬০০ এর কাছাকাছি হয়েছে। করোনাকালে ভারত চার হাজার টনের বেশি তরল অক্সিজেন সরবরাহ করেছে। এসবই বাংলাদেশের এবং দুই দেশের বন্ধুত্ব এর উদাহরণ।
ভারতীয় রেলমন্ত্রী আরও বলেন, গতকাল বাংলাদেশের রেলমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনাকালে সুজন জানান সেদেশের রেলের ব্রডগেজ, রেলের বৈদ্যুতিকরণ, সিঙ্গেল থেকে ডাবল লাইনে উন্নীত করা হবে - আমি তার প্রশংসা করছি এবং এক্ষেত্রে বাংলাদেশ দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। আর এই কাজে প্রয়োজনে বড় পাহাড়ের মত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াবে ও ভারত সব রকম সহায়তা করতে প্রস্তুত বলেও জানান অশ্বিনী বৈষ্ণব। তার অভিমত আমরা কখনই আমাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি থেকে পিছপা হব না।
অন্যদিকে বাংলাদেশের রেলমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, ভারত বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল তাতে ভারতের অংশগ্রহণ, এক কোটি শরণার্থী আশ্রয় দেওয়া, ১৬ হাজারের মতো ভারতীয় সৈন্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সামিল হয়ে রক্ত দিয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে সম্পর্ক তা রক্ত আকারে লেখা, রক্তের বন্ধন অত্যন্ত মজবুদ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও দেখেছি দুই দেশের মধ্যে যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এটি অনেক বেশি গভীর হয়েছে।
মন্ত্রী জানান, সপ্তাহে দু'দিন এই মিতালী ট্রেন চালু আছে কিন্তু পরবর্তীতে যদি সম্ভব হয় তবে সপ্তাহে পাঁচদিন চালানোর জন্য ভারতের কাছ প্রস্তাব রাখব। কারণ এই পথটি বাংলাদেশের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়।
তিনি বলেন, ভারতে সফরে আমি বেশ কয়েকটি জায়গায় ঘুরেছি, বিভিন্ন কারখানা দেখেছি, তারা সুশৃংখলভাবে তাদের যে প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তুলেছে তাতে আমি অভিভূত হয়েছি। আমি বিশ্বাস করি ভারতের রেল ব্যবস্থা ও তাদের যে অভিজ্ঞতা এই অভিজ্ঞতা আগে যদি বাংলাদেশের রেলের জন্য কাজে লাগাতে পারি তাহলে উভয় দেশেই উপকৃত হবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদির উদ্ধৃত ট্রেনে মন্ত্রী বলেন, আমাদের আশা দুই দেশের মধ্যে যে সোনালী অধ্যায় রয়েছে তা আরও দীর্ঘায়িত হবে, নতুন উচ্চতায় যাবে এবং বাংলাদেশ-ভারতের যে বন্ধুত্ব আরো দীর্ঘজীবী হবে।
উল্লেখ্য, দীর্ঘদিন থেকেই শিলিগুড়ি ও ঢাকার মধ্যে রেল যোগাযোগের দাবি করে আসছিল পর্যটন ব্যবসায়ীরা। অবশেষে দু'দেশের রেল মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে তা বাস্তবায়িত হল। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন পর্যন্ত চলবে এই ট্রেন।
১০ ঘণ্টায় ৫১৩ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করবে মিতালী এক্সপ্রেস। লোকো পাইলট (চালক) বদলানোর জন্য ভারতীয় দিকের শেষ স্টেশন হলদিবাড়ি এবং বাংলাদেশ সীমান্তের প্রথম স্টেশন চিলাহাটিতে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়াবে ট্রেন। এছাড়া এই যাত্রাপথে আর কোনো বিরতি নেই।
মিতালী এক্সপ্রেসে এসি কেবিন বার্থ-এ ভাড়া ৪৯০৫ রুপি, এসি কেবিন চেয়ার কার-এ ভাড়া ৩৮০৫ রুপি এবং এসি চেয়ার কার-এ ভাড়া ২৭০৭ রুপি। এনজিপি থেকে ট্রেন ছাড়বে প্রতি বুধবার এবং রবিবার সকাল ১১.৪৫ মিনিটে। ঢাকা পৌঁছাবে রাত সাড়ে দশটা নাগাদ। অন্যদিকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্রেন ছাড়বে প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে গত বছরের ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকায় মিতালী এক্সপ্রেস ট্রেনরে উদ্বোধন করেছিলেন, কিন্তু করোনা অতিমারির কারণে চালু করা যায়নি এই ট্রেন পরিষেবা।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল