বুধবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

আওয়ামী লীগ নেতার স্বজনদের পেটে ১০ টাকা কেজির চাল

প্রতিদিন ডেস্ক

হতদরিদ্রের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন জেলায় ১০ টাকা কেজি দরের চাল বিতরণ করছে সরকার। কিন্তু এ চাল পাচ্ছে না হতদরিদ্ররা। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী প্রকৃত হতদরিদ্র পরিবারের তালিকা প্রণয়নের দায়িত্ব ইউপি চেয়ারম্যান ও একজন সরকারি কর্মকর্তার নেতৃত্বে গঠিত ইউনিয়ন কমিটির। কিন্তু এ তালিকা প্রণয়ন করছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা। এতে দুস্থতা বিবেচনা না করে শুধু দলীয় বিবেচনায় তালিকা করায় অনেক সচ্ছল পরিবার তালিকাভুক্ত হয়েছে। এর ফলে রাজনীতি করে না এমন বহু দুস্থ পরিবার ১০ টাকা কেজি দরে চাল কেনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এ ছাড়া চাল বিতরণে ওজনে কারচুপিসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। কোথাও কোথাও ৩০ কেজি চাল না দিয়েও দাম রাখা হচ্ছে ৩০ কেজির। নিজস্ব প্রতিবেদক ও জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর—

রাজশাহী : নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী জানান, রাজশাহীতে ১০ টাকা কেজি দরে চাল কেনার কার্ড পেয়েছেন হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা। নাম আছে ৫০ বিঘা জমির মালিকের ছেলেরও। তবে কার্ড পাননি বিধবা নারী বা তার ভ্যানচালক ছেলে। অভিযোগ উঠেছে, স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ ও সচ্ছল পরিবারকে কার্ড দেওয়া হয়েছে, যারা ১০ টাকা কেজি চাল উত্তোলন করে বিক্রি করে দিয়েছেন। জানা গেছে, সারা দেশের মতো রাজশাহী জেলার আটটি উপজেলায় ৮১ হাজার ৪৮২টি পরিবারকে হতদরিদ্রের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ১০ টাকা কেজি দরের চাল দেওয়া হচ্ছে। জেলার কয়েকটি উপজেলায় প্রথম কিস্তির চাল বিতরণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। অন্যগুলোতে চাল দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। জেলার মোহনপুর উপজেলায় কয়েক দিন আগে হতদরিদ্রের বরাদ্দকৃত চাল বিতরণ করা হয়েছে। এতে ৫০ বিঘা জমি এবং কোটি টাকার সম্পদ আছে এমন পরিবারের নামে এ চাল বরাদ্দ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। আবার আওয়ামী লীগ নেতার একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তির নামে এবং তার আত্মীয়দের মধ্যে এ চাল বিতরণ করা হয়েছে। উপজেলার বাকশিমইল ইউনিয়নের ভেটুপাড়া গ্রামের ৫০ বিঘা জমির মালিক হোসেন মৃধার ছেলে শিহাব পেয়েছেন খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির কার্ড। তিনি মুদি ব্যবসায়ী। কিন্তু কৃষ্ণপুর গ্রামের মৃত আবদুলের বিধবা স্ত্রী নিলুফা এ কার্ডের আওতায় আসেননি। নিলুফার দুই ছেলের মধ্যে এক ছেলে রাজশাহী কলেজে অনার্সের শিক্ষার্থী, যে এক বেলা ভ্যান চালিয়ে তাদের সংসার চালায়। আবার ওই গ্রামেরই মৃত বারিকুল্লার প্রতিবন্ধী ছেলে মজিবর রহমান কার্ড পাননি। কার্ড পাননি ভ্যানচালক মনজুর। কৃষ্ণপুর গ্রামের ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম পেয়েছেন এই কার্ড। শুধু তিনিই নেননি। ওই নেতার দুই ভাই এনামুল ও এমদাদুলও পেয়েছেন ১০ টাকা কেজি চাল সংগ্রহের কার্ড। এ ছাড়া নেতার তিন চাচা ওবায়দুল, আবদুল কুদ্দুস ও আলতাব হোসেন, চাচাতো ভাই ময়েজ উদ্দিন ও বাবু এবং তার পরিবারের তিন জামাই এসলাম, আয়নাল হক ও মোকবুল হোসেন পেয়েছেন এই কার্ড। এ ছাড়া কার্ড পেয়েছেন ওই গ্রামের ময়েজ উদ্দিন, বাবুল হোসেন ও এনামুল। তাদের কোটি টাকার সম্পদ আছে। উপজেলার মৌগাছি ইউনিয়নেও কার্ড পেয়েছেন বিত্তশালীরা। মৌগাছি গ্রামের আশরাফ আলী কার্ড পেয়েছেন, যার পাকা বাড়ি আছে। কার্ড পেয়েছেন মৌগাছি বাজারে হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী মোশারফ হোসেন। অথচ একই গ্রামের প্রতিবন্ধী আশরাফ ও আবদুর রশিদ কার্ড পাননি। এ ইউনিয়নে কার্ড পেতে ২০০ টাকা করে গুনতে হয়েছে অনেককেই। আবার ডিলারদের বিরুদ্ধেও ওজন কম দেওয়ার অভিযোগ আছে। প্রতিটি কার্ডে ৩০ কেজি দেওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া হচ্ছে ২৮ কেজি থেকে ২৯ কেজি। অথচ দাম নেওয়া হচ্ছে ৩০ কেজির।

দিনাজপুর : দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, সরকারের ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি কর্মসূচির হতদরিদ্র পরিবারের তালিকা প্রণয়ন ও চাল বিতরণে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী হতদরিদ্র পরিবারপ্রধানরা মাসে প্রতি কেজি ১০ টাকা দরে চাল পাবেন। কিন্তু এ নিয়ম অনুসরণ না করে অনেক সচ্ছল পরিবারকে এ চাল দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া পার্বতীপুরের ১০ ইউনিয়নে ৩২ ডিলারের বেশির ভাগ সরকারি দলের নেতা-কর্মী বলে স্থানীয়রা জানান। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী প্রকৃত হতদরিদ্র পরিবারের তালিকা প্রণয়নের দায়িত্ব ইউপি চেয়ারম্যান ও একজন সরকারি কর্মকর্তার নেতৃত্বে গঠিত ইউনিয়ন কমিটির। কিন্তু মাঠপর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকৃতপক্ষে তালিকা প্রণয়ন করছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সম্পাদকের নেতৃত্বে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকরা। এতে শুধু দুস্থতা বিবেচনা না করে দলীয় বিবেচনায় তালিকা করায় উপজেলার সব ইউনিয়নে অনেক সচ্ছল পরিবার তালিকাভুক্ত হয়েছে। এর ফলে রাজনীতি করে না এমন বহু দুস্থ পরিবার ১০ টাকা কেজি দরে চাল কেনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, পার্বতীপুর উপজেলার মোমিনপুর ইউনিয়নের ২ নম্বর গোবিন্দপুর ওয়ার্ডের দক্ষিণপাড়ার আ. মান্নান (কার্ড নম্বর ১৫৩) ও তার ছেলে আবু তাহের (কার্ড নম্বর ১৫৪) প্রায় ছয় একর জমির মালিক। এর পরও বাবা-ছেলে দুজনই কার্ড পেয়েছেন, চালও তুলেছেন। ২ নম্বর গোবিন্দপুর ওয়ার্ডের ইউপি মেম্বার ফাইজুল ইসলাম অভিযোগ করেন, তার ওয়ার্ডে পাঁচটি মৌজায় ১৮টি পাড়া। কার্ডের বরাদ্দ ১৩১টি। নেত্রকোনা : নেত্রকোনা প্রতিনিধি জানান, হতদরিদ্রদের জন্য ১০ টাকা কেজিতে চাল বিক্রির তালিকায় উঠে এসেছে শিক্ষক, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতাসহ ডিলারের পরিবারের লোকজনের নাম। জেলার কলমাকান্দার কৈলাটী ইউনিয়নে হতদরিদ্রদের মধ্যে স্বল্পমূল্যে চাল বিক্রিতে এ অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। দরিদ্রদের পরিবর্তে স্বল্পমূল্যের এ চাল যাচ্ছে সচ্ছল, ধনী ও দলীয় প্রভাবশালী নেতাদের পেটে। কৈলাটী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ডিলার হায়দার আলী খানের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ডিলারের গরিব আত্মীয়স্বজন থাকতে পারে না? তবে ইউপি চেয়ারম্যান মো. রুবেল ভূঁইয়া বলেন, তারা আওয়ামী লীগ নেতা। তাই প্রভাব খাটিয়ে এসব তালিকা নিজেরাই করেছে। গাইবান্ধা : গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান, জেলার ছয়টি উপজেলায় ১০ টাকা কেজি দরের চাল বিক্রি কার্যক্রম শুরু হলেও সংসদের ডেপুটি স্পিকারের নির্বাচনী এলাকা গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) এর সাঘাটা উপজেলার নয়টি ইউনিয়নে এখনো চাল বিক্রি শুরু হয়নি। তালিকা তৈরি নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার কারণে এখানে চাল বিক্রি শুরু করা যায়নি বলে জানা গেছে। কয়েকজন ইউপি চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, ডেপুটি স্পিকার ও ইউপি চেয়ারম্যানদের দ্বন্দ্বের কারণে সাঘাটা উপজেলার নয়টি ইউনিয়নে চাল বিক্রি এখনো শুরু হয়নি।

কচুয়া ইউনিয়নের বুরুঙ্গি গ্রামের দিনমজুর আনারুল হক ও বাদশা মিয়া বলেন, ‘বাজারে এক সের চাউলের দাম ৩৫-৪০ ট্যাকা। সেই চাউল ১০ টাকায় পাওয়া গেলে পরিবারের সবার পেটে ভাত জুটত। কিন্তু চেয়ারম্যান-মেম্বারের কাছে গেলে তারা জানায়, একটু অসুবিধা হয়েছে পরে চাল দেওয়া হবে।’ উপজেলার বোনারপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল ওয়ারেছ প্রধান বলেন, লোকসংখ্যা অনুযায়ী এ ইউনিয়নে এক হাজার ৬২৬টি কার্ড বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি মিয়া এই ইউনিয়নে ৫০০ জন সুবিধাভোগীর নামের তালিকা-সংবলিত একটি চিঠি দায়িত্বপ্রাপ্ত উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তাকে দিয়েছেন। এর ফলে তালিকা চূড়ান্ত করা যাচ্ছে না। এ কারণে চাল বিক্রিও শুরু করা যাচ্ছে না। এসব বিষয়ে জানতে ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি মিয়ার সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

সর্বশেষ খবর