শুক্রবার, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

লেখকের বাসা

শীলা আহমেদ

লেখকের বাসা

আমার বাবা ছিলেন লেখক মানুষ। তার ছোট্ট কাঠের একটা টুল ছিল। সেটা নিয়ে যেখানে সেখানে লিখতে বসে যেতেন। আমাদের খেলা-ঝগড়া-হাসাহাসি কোনো কিছু্ তার লেখালেখিতে সমস্যার সৃষ্টি করতে পারত না।

এবার প্রথম আমার বরকে দেখলাম লেখক হিসেবে। একেবারে বাবার উল্টো। ওর লেখার জন্য পিসফুল মাইন্ড লাগে। চুপচাপ বাসা লাগে। আর লেখার সময় কেউ ওর সঙ্গে কথা কথা বলতে পারবে না। বেচারার জন্য বিরাট ঝামেলা হয়ে গেল! পিসফুল মাইন্ড সম্ভব নয়, কারণ ছোটবেলা থেকে আমি খুব ঝগড়াটে। চুপচাপ বাসা সম্ভব নয়, কারণ বাসায় চারটা বাচ্চা। আর ওকে একটু পরপর ডাকাডাকি করা আমার স্বভাব।

এত ঝামেলার মধ্যে ও যখন একটা উপন্যাসের অর্ধেকের মতো লিখে ফেলল, তখন আমাকে পড়তে দিল। বলল, ‘পড়ে দেখ তো কেমন হয়েছে? কোনো জায়গা ঠিক করতে হলে বোলো।’ আমি বললাম, ‘অবশ্যই পড়ব, কিন্তু কোনো জায়গা ঠিক করতে হবে কিনা, বলতে পারব না। আমি তো লেখকের মেয়ে, সারা জীবন দেখেছি লেখকরা আলোচনা সহ্য করতে পারেন না। বাবাকে কোনো লেখা নিয়ে একটু কিছু বললে প্রচণ্ড রেগে যেতেন। এমন বকাবকি শুরু করতেন ভয়ে অনেকক্ষণ সামনে যেতাম না!’

ও হাসতে হাসতে বলল, ‘আরে ধুর! আমি কি তোমার বাবার মতো ছেলেমানুষ নাকি! আমাকে চেন না? আমি খুব ভালোভাবে সমালোচনা নিতে পারি। তুমি নির্দয়ভাবে সমালোচনা করবে।’

: ‘কেমন হয়েছে?’

: ‘ভালো!’

: ‘ভালো মানে কী। ঠিকমতো বল।’

আমি ওকে অল্প কিছু বলি। ‘মনে হয় এ জায়গাটায় একটু তাড়াহুড়া করেছ।...’ কিছুক্ষণ স্বাভাবিক মুখে আমার কথা শোনে। তারপর রাগি রাগি হয়ে যায়। আমাকে বলে, ‘থাক, তোমার আর বলা লাগবে না। আমি তো দেখলাম তুমি লাইন বাদ দিয়ে দিয়ে পড়ছিলে। তোমার মন ছিল না পড়ার মধ্যে।’

আমি ওর হাত ধরি। বলি, ‘রাগ করছ কেন?’ ও আরও রেগে যায়। উঠে চলে যায় আমার সামনে থেকে। রাতে ভাত খায় না ঠিকমতো। আমি বকা খাওয়ার ভয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে চলে যাই। অনেক সকালে ও আমাকে ডেকে তোলে। বলে, ‘এসো তো, পড়ে দেখ এখন। আমি ঠিক করেছি।’

ওর লেখা পড়তে গিয়ে আমার কান্না চলে আসে। কতদিন পর আবার এক রকম ঘটনা ফিরে এলো। বাবাও তো কিছুক্ষণ পরপর ডাকতেন, ‘শীলা বাবা! এখন পড়ে দেখ তো ঠিক করেছি।’ যেন আমি (!) কত বড় একজন ক্রিটিক! যেন কত কিছু যায় আসে আমার ভালো লাগায়, আর না লাগায়!

আমার বাবা ছিলেন একজন লেখক। আর আমার কাছে আমাদের বাসাটা ছিল লেখকের বাসা। ছোট্ট কাঠের টুলে বাবা লিখতেন। মা চা বানিয়ে দিতেন একটু পরপর। প্রকাশকরা আসতেন। মা প্রুফ দেখে দিতেন। ধ্রুব এষ প্রচ্ছদ নিয়ে এসে চুপচাপ বসে থাকতেন ঘরের কোনায়! যখন বই বের হতো বইয়ের সঙ্গে সঙ্গে বাসায় মিষ্টি আসত। আমরা চারজন (মা, নোভা, আমি আর বিপাশা) চারটা বই খুলে বসতাম। বাবা পায়চারি করতে করতে সিগারেট খেতেন। বই পড়তে পড়তে কখনো হেসে উঠলে সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করতেন, ‘কোন জায়গাটা পড়ছ বাবা?’ বই পড়া শেষ হলে বলতেন, ‘বাবা চোখে পানি এসেছে?’ আমরা খারাপ কোয়ালিটির পাঠক ছিলাম, বাবার সব বই পড়েই চোখে পানি চলে আসত।

আমার বরের উপন্যাস লেখা শেষ হয়। এক রাতে ও আমার হাতে ওর নতুন বইয়ের একটা কপি তুলে দিয়ে বলে, ‘এটা তোমার জন্য! তুমি খুশি তো?’

‘প্রিয়তম স্বামী! আমি প্রচণ্ড খুশি। তোমার বই মাস্টারপিস হয়েছে অথবা কিছু্ হয়নি তার জন্য খুশি নই। খুশি এজন্য যে, তোমার এ বই আর বই লেখার জার্নি আমাকে প্রাউড করেছে, নস্টালজিক করেছে, একটু একটু জেলাস (প্রথম প্রেম নিয়ে উপন্যাস লিখলে তো একটু জেলাস হবই!) করেছে।

হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, আমাদের এখন কোনো লেখার ছোট্ট টুল নেই, প্রকাশকদের আড্ডা নেই, চুলায় সারাক্ষণ চা নেই, ধ্রুব এষের প্রচ্ছদ নিয়ে আসা নেই (এখন প্রচ্ছদ নেটে চলে আসে!), মিষ্টিও নেই। তাতে কী! এটা না হয় আমাদের অন্যরকম লেখকের বাসা হলো!

তোমার জন্য অনেক শুভ কামনা আর দোয়া।’ [ফেসবুক থেকে সংগৃহীত।]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর