শনিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

মিথ্যা মানুষ

মির্জা মেহেদী তমাল

মিথ্যা মানুষ

নিপা (ছদ্মনাম)। সবেমাত্র স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছে মেয়েটি। কলেজে ভর্তি হবে। নাসির নামে এক তরুণের সঙ্গে নিপার ফেসবুকে পরিচয়। অচেনা নাসিরের কাছ  থেকে একটি বন্ধুত্বের আহ্বান পায় নিপা ফেসবুকের মাধ্যমে। নাসিরের প্রোফাইল চেক করে নিপা। তরুণ নাসির দেখতে ভালো। ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। তরুণ আইনজীবী। এমন প্রোফাইল দেখে ভালোই লাগে নিপার। গ্রহণ করে বন্ধুত্বের আহ্বান। সেদিন থেকেই ইনবক্সে শুরু হয় তাদের কথোপকথন। সুন্দর কথা বলে ছেলেটি। এ বিষয়টি নিপার আরও ভালো লাগে। ইনবক্সে ছেলেটি ছবি পাঠায়। নিপাও ছবি পাঠায়। দুজন দুজনের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে। দুজনের মধ্যে ভালোলাগা কাজ করে। অচেনা অদেখা একটা মানুষ নিপার মনে বড় আসন গেড়ে বসেছে। কথোপকথনের চার মাস পর নাসির দেখা করতে চায় নিপার সঙ্গে। নিপাও মনে মনে চাচ্ছিল তাই। এত ঘনিষ্ঠ হয়ে গেছে তারা, দেখা তো এখন হতেই পারে। ভাবে নিপা। নাসিরের প্রস্তাবে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যায় নিপা।

নিপা চট্টগ্রামের রাউজানে তাদের বাসার কাছাকাছি একটা স্থানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। নাসির আসবে। তার মনে ভীষণ উত্তেজনা কাজ করছে। কেমন হবে ছেলেটি সামনা সামনি, ছেলেটি তাকে পছন্দ করবে কিনা—এমন নানা চিন্তা কাজ করছে নিপার মনে। সন্ধ্যা গড়িয়ে যাচ্ছে। চারদিকে অন্ধকার নেমে আসছে। কিন্তু নাসির আসছে না। অস্থির হয়ে পড়ছে নিপা। এমন এক অবস্থায় একটি মাইক্রোবাস এসে থামে নিপার সামনে।

নিপা তাকাচ্ছে গাড়ির ভিতর। এমন গাড়ির কথাই বলেছিল নাসির। কিন্তু গাড়ি থেকে নেমে আসছেন একজন মধ্য বয়স্ক লোক। নিপা ভাবে এই গাড়ি নয়। কিন্তু লোকটি নিপার সামনে এসেই বলে, সে তার নাসির। নিপা ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে থাকে, বুঝতে পারে সে বড় ভুল করে ফেলেছে। অদেখা, অচেনা এক মানুষকে আপন ভাবা এবং তার সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতার ভুল সিদ্ধান্ত ছিল তার। নিজের কপালে চপেটাঘাত করতে ইচ্ছে হচ্ছে নিপার। কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে। তাত্ক্ষণিকভাবে প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে ঘটনাস্থল থেকে চলে যাওয়ার উদ্যোগ নেয় নিপা। কিন্তু নাসির নিপার মুখে রুমাল গুঁজে অজ্ঞান করে ফেলে। তাকে জোর করে গাড়িতে তুলে নেয়। এরপর এক নির্মম ইতিহাস। নিপাকে একাধিক আবাসিক হোটেল ও কয়েকটি পৃথক বাসায় বন্দী রেখে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন চালাতে থাকে নাসির। এদিকে মেয়ের সন্ধান না পেয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে রাউজান থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরিও করা হয়। কিন্তু সম্ভাব্য সব স্থানে খুঁজেও অভিভাবকরা নিপার কোনো সন্ধান পেতে ব্যর্থ হন। এর মধ্যে ওই প্রতারকের কাছে বন্দী থাকা অবস্থায় তরুণী বেশ কয়েকবার পালানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। একপর্যায়ে নিপা পালিয়ে আসার কৌশল হিসেবে নিজেকে মানসিক অসুস্থ হিসেবে অভিনয় শুরু করেন। বন্দী থাকা বাসার সবকিছু ভাঙচুর করতে থাকলে নাসির তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যায়। সেখান থেকে  কৌশলে পালিয়ে পরিবারের কাছে ফিরতে সক্ষম হন নিপা। বাড়ি ফিরেই ঘটনা খুলে বলে নিপা। পরিবারের পরামর্শে ফাঁদ পেতে প্রতারক নাসিরকে নিপার বাড়ির কাছাকাছি এলাকায় ডেকে আনা হয়। এ সময় এলাকাবাসী তাকে আটক করে ব্যাপক গণপিটুনি দেয়। পরে তাকে রাউজান থানার পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়। গ্রেফতার হওয়া ৫৫ বছর বয়সী এই প্রতারক-ধর্ষকের নাম নাসির উদ্দিন। প্রতারক নাসির চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের একজন কর্মচারী।  ফেসবুকে নাসির তরুণ বয়সের ছবি এবং নিজেকে ১৮ বছর বয়সী পরিচয় দিয়ে নিপাকে আকৃষ্ট করে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে নাসির তরুণী নিপাকে দেড় মাস ধরে আটকে রেখে যৌন নির্যাতনের কথা স্বীকার করে। পুলিশ জানায়, ইনিয়ে বিনিয়ে, মিথ্যে বলে, সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ করে বিয়ে অবদি নিয়ে যাওয়াই ছিল তার নেশা। পেশা বললেও অত্যুক্তি হয় না। এক জীবনে একাধিক বিয়ে করতে কুণ্ঠা যার নেই, তার কাছে বিয়ে তো পেশার মতোই। কিন্তু নিপার ঘটনায় তার শেষ রক্ষা হলো না। ধরা পড়তেই হলো তাকে।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে নাসির জানায়, তিনি প্রথম বিয়ে করেন ১৯৯১ সালে। ওই ঘরে ২০ বছর বয়সী কন্যাসন্তানকে বিয়ে দিয়েছেন। প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর দ্বিতীয় বিয়ে করেন ৯৮ সালে। এই ঘরেও রয়েছে তার এক ছেলে ও দুই মেয়ে। পরে আরও বিয়ে করেছে বলে পুলিশের কাছে খবর রয়েছে। ভার্চুয়াল জগতের ফেসবুক আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। প্রতিদিনের নিত্যনৈমিত্তিক কাজের মতোই ফেসবুকে দিনের অনেকটা সময় ব্যয় না করলে যেন চলে না। ফেসবুকের উদ্ভব হয়েছিল একটি সামাজিক গণযোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে, কাছে এবং দূরের বন্ধু-বান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনদের মাঝে  যোগাযোগ রক্ষার জন্য। কালক্রমে ফেসবুক ব্যবহারের ধরনের আমূল পরিবর্তন এসেছে। আজকাল ফেসবুকে আসল পরিচয়ের মানুষের সংখ্যার থেকে মিথ্যা মানুষের সংখ্যাটা অনেক বেশি বলে ধারণা করা হয়। সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, ফেসবুক ব্যবহারকারীর মোট শতাংশের মধ্যে মুখোশধারী মিথ্যা মানুষের সংখ্যা প্রায় ৮.৭ শতাংশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপাক, সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, আমরা যদি সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখি এবং তাদের কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করি বা তাদের সঙ্গে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আলোচনা করি, তাহলে হয়তো উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা কিছুটা হলেও সচেতন হবে। এ ছাড়াও সামাজিক এবং ধর্মীয় শিক্ষার আলো তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া একান্ত প্রয়োজন।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর