মঙ্গলবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

বিপজ্জনক কিশোর গ্যাং

মির্জা মেহেদী তমাল

বিপজ্জনক কিশোর গ্যাং

আরাফাতের বয়স সতেরো। গুলশানের একটি গ্যারেজে কাজ করে এই কিশোর। একদিন পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। আরাফাতের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর অভিযোগ। সে একাই খুন করেছে তার এক বন্ধুকে। শুধু তাই নয়, খুনের পর তার বন্ধুর বাবা-মায়ের কাছে ফোন করে দুই লাখ টাকা মুক্তিপণও চেয়েছে। মাত্র ১৭ বছরের এই কিশোরের ভয়ঙ্কর এমন রূপ দেখে পুলিশের ভিমরি খাবার অবস্থা। বলে কি ছেলেটা, একা তার বন্ধুকে গলা কেটে হত্যার পর লাশ নিয়ে বসে ছিল সকাল পর্যন্ত! এরপর ফোন করে মুক্তিপণ দাবি! পুলিশ প্রথমে বিশ্বাস করতে না পারলেও তথ্য-প্রমাণ আর তদন্তে বেরিয়ে আসে একই ঘটনা। রাজধানীর গুলশানের নিকেতন আবাসিক এলাকায় বিজ্ঞাপনী সংস্থা টিনসেল টাউনের কর্মচারী শাকিলকে (১৮) গলা কেটে হত্যার পর আরাফাতকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ নিশ্চিত হয়, পাওনা টাকা না দেওয়ায় আরাফাত ওই অফিসেই এমন খুনকাণ্ড ঘটায়।

পূর্ব রামপুরার একটি ব্যস্ত রাস্তায় খুন হন একজন ঠিকাদার। পুলিশ সেখানকার সিসিটিভির ফুটেজ উদ্ধার করে। সেই ফুটেজে দেখা যায়, ১৭/১৮ বছরের কয়েকজন কিশোর এক তরুণকে ধারালো অস্ত্র নিয়ে ধাওয়া করে আসছে। কিছুদূর দৌড়ে এসে তরুণটি আর নিজেকে বাঁচাতে পারল না। জনসম্মুখে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই কিশোররা। কেউ এগিয়ে আসার সাহস দেখালো না। চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায় প্রাণ দিতে হলো তাকে। পেশাদার খুনি হিসেবে কিশোরদের ব্যবহার বাড়ছে। কারণ তাদের নাকি সস্তায় ‘কেনা’ যায়। কিশোর মুখগুলো ক্রমশ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে তারা। এরা নিজেদের কিশোর গ্যাং বলেই ভাবতে চায়। ছিনতাই, মাদক ব্যবসা, এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে একের পর এক ঘটছে খুনের ঘটনা। এমন কি পান থেকে চুন খসলে খুনের ঘটনাও ঘটেছে। কিশোর এসব অপরাধীর হাতে অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে একাধিক খুনের ঘটনা ঘটেছে। খুনের ঘটনার পর নড়েচড়ে বসেছে পুলিশ। চট্টগ্রামেও এর ব্যাপকতা বেড়েছে। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন অপরাধ মানেই কিশোরমুখ। সেটা হত্যা হোক, অপহরণ হোক কিংবা মাদকপাচার। এ কারণে সতর্ক এবং উদ্যোগী হতে হবে এখনই। নইলে আপনার আশপাশে যে কিশোররা ঘুরে বেড়াচ্ছে, তারা কি আপনাকে হত্যা বা অপহরণ করতে ওতপেতে আছে কে বলবে তা। জানা গেছে, রাজধানীর কিশোর গ্যাংগুলো ফের পুরোদমে সক্রিয়। এই গ্যাং এখন রীতিমতো আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের বেপরোয়া কাণ্ডে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী। চায়ের দোকান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনের সড়ক এমনকি বিভিন্ন শপিং মলের আশপাশে কিশোর গ্যাংয়ের একাধিক দলের সদস্য ঘোরাঘুরি করে। চায়ের দোকানগুলোয় সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি আড্ডায় মেতে থাকে। আর স্কুল-কলেজের ছুটির সময়ও এদের উৎপাতে অস্থির হয়ে ওঠেন সেখানে আগত অভিভাবকরা। পাশাপাশি রাস্তাঘাট এমনকি নিরিবিলি পরিবেশকে তারা মুহূর্তে অশান্ত করে তোলে। গত ২০ মার্চ ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে নাবিল নামের এক স্কুলছাত্রকে ছুরিকাঘাত করে জীবন ঢালী নামের আরেক কিশোর। জানা যায়, জীবন ঢালী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। এ বিষয়ে উত্তরার পশ্চিম থানায় মামলা হওয়ার পর জীবনের পরিবার তাকে থানায় নিয়ে পুলিশের হেফাজতে দেয়। চট্টগ্রামে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কথিত ‘বড় ভাইদের’ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ড ও এলাকাভিত্তিক গড়ে উঠেছে ছোট বড় দুই শতাধিক কিশোর গ্রুপ। এসব গ্রুপের বেশিরভাগ সদস্যের বয়স ১৩ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। একেকটি গ্রুপে সদস্য রয়েছে ১৫ থেকে ২০ জন। কোনো কোনো গ্রুপের আবার এর চেয়ে বেশি সদস্য রয়েছে। গ্রুপের সদস্যরা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চ্যাট গ্রুপ তৈরি করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে। ওই  গ্রুপগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন সংশ্লিষ্ট এলাকার কথিত কিছু বড় ভাই। তারাই এসব কিশোরদের হাতে তুলে দেন অবৈধ অস্ত্র। অপরাধ জগতে পা বাড়াতে উৎসাহ দেন। অনেক বড় ভাই নিজের মাদক ব্যবসা, ছিনতাই ও অপরাধ রাজ্য ধরে রাখতে ব্যবহার করছে কিশোর গ্রুপের সদস্যদের। জানা যায়, ১৮ জুন পাওনা টাকা নিয়ে দ্বন্দ্বে বন্ধুর হাতে খুন হন মো. জসিম নামে এক কিশোর। ১৭ জুন নগরীর চট্টেশ্বরী এলাকায় হর্ন দেওয়াকে কেন্দ্র করে খুন জন আবু জাফর অনিক নামে এক যুবক। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে এক কিশোরসহ চারজনকে  গ্রেফতার করে পুলিশ। একই দিন হালিশহরে সিনেমা দেখে ফেরার পথে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে খুন হন মো. সুমন নামে এক কিশোর। ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ৩১ মে ৭ কিশোরকে গ্রেফতার করে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপাক, সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, আমাদের সমাজে নানা টানাপড়েনে সেই বন্ধনগুলো আলগা হতে হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। পরিবারের কাছে তার সদস্যদের জবাবদিহিতার জায়গা কমে এসেছে। নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো যেমন জানে না তাদের সন্তানরা কোথায় আছে, কী কাজ বা গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, তেমনি উচ্চবিত্ত পরিবারের কাছেও এই তথ্য নেই। নিচের দিকে শিক্ষা নেই, উপরে শিক্ষা আছে কিন্তু পারিবারিক সুশাসন নেই। নিচের দিকে শিক্ষার পাশাপাশি কাজেরও সংকট আছে। কেবল যে পুঁথিগত শিক্ষা দিতে হবে তা নয়। দরকার কর্মমুখী কারিগরি শিক্ষা। এই কারিগরি শিক্ষার দিকে রাষ্ট্রের নজর কম। কারিগরি শিক্ষা কিশোর-তরুণদের কর্মমুখী করে তুলবে। তারা আয়ের উৎস খুঁজতে অপরাধের দিকে যাবে না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর