শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

‘আধুনিক বসতি’ পাচ্ছেন পায়রা বন্দরের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার

রাহাত খান, বরিশাল

‘আধুনিক বসতি’ পাচ্ছেন পায়রা বন্দরের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার

সরকারি কোনো প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণ প্রয়োজন হলে মালিকরা জমি দিতে বাধ্য। বর্তমান আইনে অধিগ্রহণকৃত জমির প্রকৃত মূল্যের তিনগুণ পাবেন জমির মালিক। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্য সাড়ে ছয় হাজার একর জমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত সাড়ে তিন হাজার পরিবারকে জমি, স্থাপনা, গাছপালা-ঘরবাড়ির তিনগুণ মূল্য পরিশোধ ছাড়াও দেওয়া হচ্ছে আধুনিক বসতি। জমি অধিগ্রহণের ফলে যারা বসতি হারিয়েছেন (গৃহহীন), সেই ধরনের সাড়ে তিন হাজার পরিবারের জন্য আধুনিক বসতি নির্মাণ করে দিচ্ছে পায়রা সমুদ্রবন্দর কর্তৃপক্ষ। এর আগে জমি অধিগ্রহণে বসতি হারানো কোনো পরিবারকে বসতি নির্মাণ করে দেয়নি সরকার। তাই পায়রা বন্দরের জমি অধিগ্রহণে বসতি হারানো সাড়ে তিন হাজার পরিবারের জন্য নির্মাণাধীন আধুনিক বসতিকে (টাউনশিপ) ‘প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ পুরস্কার’ বলে অভিহিত করেছেন কর্মকর্তারা। শুধু বসতি পুরস্কার নয়, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর চার হাজার ২০০ নারী-পুরুষকে আত্মনির্ভরশীল করতে দেওয়া হচ্ছে ১৫৫ ধরনের প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষিত অনেকেই ইতিমধ্যে লেগে পড়েছেন নির্মাণাধীন পায়রা বন্দরের বিভিন্ন প্রকল্পের কাজে। ২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় দেশের তৃতীয় সমুদ্রবন্দরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পায়রা বন্দর পূর্ণাঙ্গ হবে সাড়ে ছয় হাজার একর জমিতে। ইতিমধ্যে দুই হাজার ৩৭৩ একর জমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াধীন। ইতিমধ্যে অধিগ্রহণ করা এবং প্রক্রিয়াধীন অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাড়ে তিন হাজার পরিবার। যাদের জমি অধিগ্রহণ হয়ে গেছে তারা তাদের জমিসহ স্থাপনা-গাছপালার তিনগুণ মূল্য পাচ্ছেন প্রচলিত আইনে। এদের মধ্যে জমি অধিগ্রহণে যারা বাস্তুহারা (গৃহহীন) হয়েছেন কিংবা হবেন, সেই ধরনের সাড়ে তিন হাজার পরিবার অতিরিক্ত হিসেবে পাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপহার ‘আধুনিক বসতি’ টাউনশিপ। পায়রা সমুদ্রবন্দর কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তফা আশিক আলী জানান, পায়রা বন্দরের জন্য সাড়ে ছয় হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। ইতিমধ্যে দুই হাজার ৩৭৩ একর জমি অধিগ্রহণ হয়েছে। বাকি জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াধীন। বন্দরের জমি অধিগ্রহণের ফলে গৃহহীন হওয়া বা হতে যাওয়া ৩ হাজার ৫০০ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পুনর্বাসনের জন্য আনুষঙ্গিক সুবিধাদিসহ ৪৩৮ একর জমিতে এক হাজার ৫৯ কোটি টাকা ব্যয়ে লালুয়া, উত্তর চান্দুপাড়া, দক্ষিণ চান্দুপাড়া, লেমুপাড়া, ধুলাসার এবং লোন্দা এলাকায় পৃথক ছয়টি আবাসন নির্মাণ করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রতিটি টাউনশিপ এলাকায় চারতলাবিশিষ্ট স্কুল-কাম-কমিউনিটি সেন্টার-কাম-কমিউনিটি ক্লিনিক-কাম-শেল্টার স্টেশন, মার্কেট, মসজিদ, কবরস্থান, প্রতিটি আবাসনে দুটি খেলার মাঠ, দুটি করে পুকুর এবং হাঁস-মুরগি পালন ও সবজি চাষের জন্য সুপরিসর উঠোন পাবেন বাসিন্দারা। থাকছে সুপেয় পানি সরবরাহের ব্যবস্থা। প্রতিটি টাউনশিপে দুই ধরনের বাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত যাদের ২০ শতাংশের ওপরে ভিটাবাড়িসহ বসতঘর ছিলাতারা পাচ্ছেন ‘এ’ টাইপ অর্থাৎ ৬.৫৭ শতাংশ জমির ওপর ৭১৬ ঘনফুট আয়তনের পাকা বসতি এবং যারা ২০ শতাংশের কম ভিটাবাড়িসহ বসতি হারিয়েছেন, তারা পাচ্ছেন ৪.৯৬ শতাংশের ওপর ৬৩২ ঘনফুট আয়তনের ‘বি’ টাইপ পাকা বাড়ি।

প্রতিটি পরিবারের জন্য প্রতিটি একতলা পাকা বসতিতে থাকছে তিনটি বেড রুম, স্টোর রুম, কিচেনসহ আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা। সুপেয় পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ছাড়াও প্রতিটি পরিবারের জন্য থাকছে সবজি চাষ এবং হাঁস-মুরগি পালনের জন্য সুপরিসর পৃথক উঠোন। প্রায় আড়াই মাস আগে এই ছয়টি টাউনশিপের নির্মাণকাজ শুরু হয়। ইতিমধ্যে টাউনশিপ প্রকল্পের ১৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। আগামী জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তফা আশিক আলী। পাকা বসতি নির্মাণ ছাড়াও জমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ৪ হাজার ২০০ নারী-পুরুষকে আত্মনির্ভরশীল করার লক্ষ্যে ১৫৫ ধরনের দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রশিক্ষিত অনেকেই লেগে পড়েছেন পায়রা বন্দরের বিভিন্ন প্রকল্পের নির্মাণকাজে।

 

তাদের একজন মেরাওপাড়ার মো. রিপন জানান, আগে তিনি ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। বন্দর কর্তৃপক্ষের দেওয়া প্রশিক্ষণ পেয়ে তিনি পায়রা বন্দরের আবাসন প্রকল্পের নির্মাণকাজে যোগ দিয়েছেন। এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো আছেন। আইজুদ্দিন নামে এক বৃদ্ধ বলেন, আগে এই গ্রামাঞ্চলে তেমন কাজের সুযোগ ছিল না। পায়রা বন্দর নির্মাণের কারণে এ এলাকায় অনেক কর্মসংস্থান হয়েছে। স্থানীয় হাজার হাজার মানুষ বন্দরের অবকাঠামো নির্মাণকাজ করায় তারা এখন স্বাবলম্বী হয়েছেন। প্রকল্প নির্মাণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হাসিবুল হাসান জানান, পায়রা বন্দর প্রকল্পের অধীনে নির্মাণাধীন টাউনশিপে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে স্থানীয় শত শত মানুষ সচ্ছলতা পেয়েছেন। তারা আগের চেয়ে অনেক ভালো আছেন।

 

স্থানীয় বৃদ্ধ পাঞ্জের আলী হাওলাদার বলেন, পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের যে জমি নিয়েছে, এর সমুদয় টাকা পেয়েছেন। এখন তারা প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপহার হিসেবে পাকা বাড়ি পাচ্ছেন। আগে অনেক কষ্টে থাকলেও এখন সুখের দিকে যাচ্ছেন মন্তব্য তার। পাঞ্জের আলীর মতো সাড়ে তিন হাজার পরিবার এখন সরকারের বিশেষ উপহারের পাকা বাড়ি পেতে উন্মুখ। পায়রা সমুদ্রবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমডোর এম জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে অধিগ্রহণ করা জমির ক্ষতিপূরণ বাবদ পাওয়া টাকা ক্ষতিগ্রস্তরা খরচ করে ফেলে। এতে ক্ষতিগ্রস্তরা বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়ে। পায়রা বন্দরের জন্য জমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্তরা বন্দরের পাশেই কর্তৃপক্ষের নির্মিত আধুনিক বসতিতে স্থায়ীভাবে থাকবেন। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষই সর্বপ্রথম জমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পাশাপাশি তাদের স্থায়ী পুনর্বাসন (পাকা বসতি) এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। উপকূলবর্তী হওয়ায় তাদের পাকা ছাদের বাড়ি দেওয়া হচ্ছে। আগামী জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষে সাড়ে তিন হাজার পরিবারকে আধুনিক পাকা বসতি বুঝিয়ে দেওয়ার কথা বলেন তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর