ঢাকার মধ্যবিত্ত পরিবারের উচ্চশিক্ষিত সাবরিনা ইসলামের সঙ্গে কয়েক মাস আগে রাজধানীর উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের ব্যবসায়ী পাত্র কায়সার আহমেদের বিয়ে হয়। বিয়ের সময় পাত্রীপক্ষের কাছ থেকে কোনো দাবি-দাওয়া না থাকলেও সাবরিনার বাবা মেয়ের সুখের জন্য সংসারের দামি আসবাবপত্র, এলইডি টিভি, ফ্রিজ, এসিসহ মূল্যবান সামগ্রী কিনে দেন। কিন্তু বিয়ের কয়েক মাস না যেতেই ব্যবসার জন্য সাবরিনাকে তার বাবার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা এনে দিতে চাপ দেয় কায়সার। সাবরিনা এতে রাজি না হলে প্রথমে মানসিক নির্যাতন, তারপর তা শারীরিক নির্যাতনে গড়ায়।
শুধু সাবরিনাই নয় ঢাকাসহ সারা দেশে তার মতো আরও অনেক তরুণীর পরিবার মেয়ের বিয়েতে সংসার গুছিয়ে দেওয়ার বাহানায় পাত্রপক্ষ ও তার পরিবারের জন্য দামি আসবাবপত্র কিনে দিচ্ছেন। অবশ্য এসব সামগ্রীর আদান-প্রদানকে সরাসরি পাত্র-পাত্রীপক্ষ যৌতুক বলতে নারাজ। কিন্তু বর্তমানে হরহামেশাই এমনটি ঘটছে। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে মেয়ের সুখের কথা ভেবে বিয়েতে মোটা অঙ্কের দ্রব্য-সামগ্রী কিনে দেওয়ার পরও পাত্রপক্ষের চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না। আর পাত্রপক্ষের চাহিদা মেটাতে না পারলেই মেয়েটির ওপর নেমে আসছে অমানুষিক নির্যাতন। হারাতে হচ্ছে প্রাণ। পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে বিয়ের এক বছর না যেতেই অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূকে হত্যা করে আত্মহত্যা বলে প্রচার করা হচ্ছে। অথচ দেশে যৌতুক প্রতিরোধে যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮ থাকলেও বাংলাদেশকে যৌতুকের অভিশাপ থেকে মুক্ত করা যাচ্ছে না ঢাকার আদালতের বিচারিক নিবন্ধন খাতার হিসাব অনুযায়ী গত ১৭ বছরে ঢাকায় ৩৭৪ জন নারীকে যৌতুকের জন্য হত্যা করা হয়। এই হিসাবে প্রতি বছর ঢাকায় যৌতুকের জন্য গড়ে ২২ জন নারীকে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, যৌতুকের কারণে সর্বশেষ গত জুলাই মাসে হত্যা করা হয় তিনজন নারীকে আর এ কারণে নির্যাতনের শিকার হন আরও সাতজন নারী। মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৮ সালে যৌতুকের কারণে মোট নির্যাতনের শিকার হয় ১৪২ জন। এর মধ্যে ৭১ জন নারীকে হত্যা করা হয় আর ৬৯ জনকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। এ ছাড়া যৌতুকের কারণে মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেন আরও দুজন। এর আগে যৌতুকের কারণে ২০১৭, ২০১৬ এবং ২০১৫ সালে যথাক্রমে ২৫৬, ২০৬ ও ২০২ জন নির্যাতনের শিকার হন। যৌতুকের কারণে ২০০৮ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত এক দশকে এক হাজার ৯২৪ জন নারীকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। গত কয়েক মাসে যৌতুকের কারণে নির্যাতিত হয়ে বেশ কয়েকজন গৃহবধূর হত্যাকান্ডে র ঘটনা ঘটেছে। সিএনজিচালক আমির হোসেনের সঙ্গে চার মাস আগে প্রেম করে গোপনে বিয়ে করে শারমিন নামের এক কিশোরী (১৭)। এরপর ঢাকার মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার এলাকায় তারা বাসা ভাড়া করে সংসার শুরু করেন। বিয়ের পর শারমিনের পরিবারের কাছে ৫০ হাজার টাকার যৌতুক চেয়েছিল। কিন্তু যৌতুকের টাকা না দেওয়ায় শারমিনের হাত-পায়ের রগ কেটে ও মুখে স্কচটেপ পেঁচিয়ে তাকে হত্যা করে আমির হোসেন। গত ১৬ আগস্ট যৌতুকের বলি হয় পাবনার বেড়া উপজেলার হাটুরিয়া নাকালিয়া ইউনিয়নের চরণাকালিয়া গ্রামের গৃহবধূ আল্লাদী খাতুন। বিয়ের পর থেকে আল্লাদীকে যৌতুকের জন্য তার স্বামী ছিদ্দিক ও তার পরিবারের লোকজন শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে আসছিল। এরপর নির্যাতনের কারণে ১৬ আগস্ট আল্লাদীর মৃত্যু হয়। সাতক্ষীরা শহরের সুলতানপুর পালপাড়ায় গৃহবধূ দিপিকা হাজরার স্বামী অনিমেষ পাল বিয়ের পর থেকেই যৌতুকের জন্য দিপিকাকে মারধর করে আসছিল। চাহিদামতো কয়েক দফা যৌতুকের টাকা নিয়েও নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পায়নি সেই গৃহবধূ। দিপিকাকে শ্বাসরোধে হত্যার পর ঘরের আড়ার সঙ্গে ঝুলিয়ে আত্মহত্যা বলে প্রচার করা হয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, যৌতুক নিরোধ আইনে নানা ধরনের ফাঁকফোকর থাকার কারণে অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। যৌতুক নিরোধ আইনে (২০১৮) যৌতুকের সংজ্ঞা নির্ধারণে বলা হয়েছে মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (শরিয়াহ) প্রযোজ্য হয় এমন ব্যক্তিগণের ক্ষেত্রে দেনমোহর বা মোহরানা অথবা বিবাহের সময় বিবাহের পক্ষগণের আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বা শুভাকাক্সক্ষী কর্তৃক বিবাহের কোনো পক্ষকে প্রদত্ত উপহার সামগ্রী যৌতুকের অন্তর্ভুক্ত হবে না। এই সুযোগে মূল্যবান অনেক সামগ্রীই এখন উপহারের নামে যৌতুক হিসেবে দেওয়া-নেওয়া চলছে। দেশে প্রচলিত যৌতুক নিরোধ আইন অনুযায়ী বিবাহে যৌতুক দাবি, গ্রহণ বা প্রদানের পাশাপাশি এক্ষেত্রে সহায়তা করার অপরাধে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদ ও ৫০ হাজার টাকার অর্থদে র বিধান রাাখা হয়েছে। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, দুঃখজনক যে দেশের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো যৌতুকের অভিযোগ আমলে নিচ্ছে না। কিছু ক্ষেত্রে নিরাপরাধ ব্যক্তিদের এই মামলায় জড়ানো হচ্ছে এতে প্রকৃত মামলাগুলো গতি হারিয়ে ফেলছে। শুধু আইনের মাধ্যমে নয় যৌতুক প্রতিরোধে দরকার সামাজিক সচেতনতা।