ঢাকা থেকে সিলেট যেতে সপরিবারে লন্ডন এক্সপ্রেস নামে একটি পরিবহনের বাসে উঠেছিলেন মোস্তাকিমুল ইসলাম। তবে গাড়িটি সিলেটে না গিয়ে তাদের হবিগঞ্জে নামিয়ে দেয় ভোর ৪টায়। পরিবার নিয়ে বিপদে পড়েন মোস্তাকিমুল। পরে তিনি ঢাকায় ফিরে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে অভিযোগ করেন। সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই ই-মেইলে শুনানির নোটিস পেয়ে হাজিরও হন। প্রতিশ্রুত সেবা না দেওয়ার অভিযোগে লন্ডন এক্সপ্রেসকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে সংস্থাটি, যার ২৫ শতাংশ বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে অভিযোগকারীকে। ঘটনাটি দুই বছর আগের। তখন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের কার্যক্রমে এমনই গতি ছিল। তবে বর্তমানচিত্র অনেকটা ভিন্ন। অভিযোগ দায়ের করার দুই বছর পেরোলেও শুনানির জন্য কোনো নোটিস পাননি, এমন অভিযোগ রয়েছে ভোক্তাদের। অন্তত চারজন ভোক্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানিয়েছেন, অভিযোগ দায়েরের পর কোনো নোটিস না পেয়ে নিজে থেকে খোঁজ নিতে এসে দেখেন, তা নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। অভিযোগকারীকে অনুপস্থিত দেখিয়ে খারিজ করা হয়েছে আবেদন। তারা হতাশা নিয়ে বলছেন, এদের (অধিদফতর) কাজ আর আগের মতো নেই। এখন আর আস্থা রাখা যায় না। আর যেসব অভিযোগ নিষ্পত্তি হচ্ছে, তাদেরও অপেক্ষা করতে হয় তিন থেকে চার মাস। সংস্থার নিজস্ব পরিসংখ্যানেও অভিযোগ নিষ্পত্তির হার কমার চিত্র পাওয়া গেছে। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে দায়ের হওয়া সাত হাজার ৫১৫টি অভিযোগের মধ্যে সাত হাজার ১৮৫টি অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার ৪৬৯ প্রতিষ্ঠানকে দন্ড দিয়েছে সংস্থাটি। ওই বছর অনিষ্পন্ন রয়েছে ৩৩০টি অভিযোগ। আর চলতি অর্থ বছর (২০১৯-২০) ১১ মার্চ পর্যন্ত ছয় হাজার ৮১৩টি অভিযোগ দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে পাঁচ হাজার ২৫০টি। আর এক হাজার ৫৬৩টি অভিযোগই অনিষ্পন্ন। চলতি বছর এখনো পর্যন্ত ৮৭৩ প্রতিষ্ঠানকে দন্ড দেওয়া হয়েছে। এর আগের বছরগুলোতে অবশ্য অভিযোগ নিষ্পত্তির হার ছিল শতভাগ।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মাহবুবুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আগে অভিযোগ করলে ই-মেইলে শুনানির নোটিস পেতাম। অভিযোগ করে জরিমানার টাকাও পেয়েছি।
তবে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি অভিযোগ দায়ের করেছিলাম। কয়েকবার খোঁজও নিয়েছি। আমার সেই অভিযোগের বিষয়ে কোনো তথ্যই জানতে পারিনি। এখন আর অভিযোগ করি না।এদিকে ভোক্তার অভিযোগ নিষ্পত্তির হার কমার পেছনে লোকবল সংকট ও বাজার অভিযানের চাপ বৃদ্ধিকে দায়ী করছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, দ্রব্য মূল্য নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত বাজার অভিযান পরিচালনার জন্য চাপ রয়েছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও বাজার অভিযান পরিচালনা করে অধিদফতরের কর্মকর্তারা। আর আইনি জটিলতার কারণে কিছু প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে অভিযোগ পেন্ডিং থেকে যাচ্ছে। সংস্থা সূত্র জানিয়েছে, লোকবল সংকট সমাধানে দুই হাজারের বেশি পদ সৃষ্টির প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। তার মধ্যে মাত্র ২০৬টি পদ অনুমোদন করেছে সরকার। সৃজনকৃত পদের অধিকাংশই অফিস সহকারী। এ নিয়েও কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা কাজ করছে।
অভিযোগ নিষ্পত্তির হার কম হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক (উপ-সচিব) মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অভিযোগ নিষ্পত্তির হার কমার বিষয়টি আসলে এমন নয়। হাই কোর্টে রিট শুনানি চলমান থাকায় মোবাইল ফোন অপারেটরদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো আমরা গ্রহণ করলেও আপাতত নিষ্পত্তি করছি না। এ জন্য এগুলো অনিষ্পন্ন রয়েছে। ভোক্তার অজান্তেই অভিযোগ খারিজ হয়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক সময় দেখা যায়, অভিযোগকারী যে ঠিকানা দেন, তা সঠিক থাকে না। এ জন্য তার নোটিসও পৌঁছে না। ফলে শুনানির দিন অভিযোগকারী অনুপস্থিত থাকলে স্বাভাবিকভাবেই অভিযোগ খারিজ হয়ে যায়।
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশে (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভোক্তার অধিকার রক্ষায় গত এক দশকে দেশে বেশ কিছু আইন হয়েছে। ওইসব আইনের আলোকে কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও তাদের সক্ষমতা গড়ে ওঠেনি। ফলে ভোক্তার অধিকার শতভাগ নিশ্চিত হচ্ছে না। তিনি বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে অভিযান যেমন জরুরি। ঠিক একই ভাবে ভোক্তার অভিযোগগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করার দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে।
আজ বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস : আজ ১৫ মার্চ আন্তর্জাতিক ভোক্তা অধিকার দিবস। বাংলাদেশসহ ১২০টি দেশ দিবসটি পালন করছে। এ বছর বাংলাদেশে দিবসটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে উৎসর্গ করা হয়েছে। দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘মুজিববর্ষের অধিকার- সুরক্ষিত ভোক্তার অধিকার’। দিবসটি কেন্দ্র করে প্রথমে র্যালিসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলেও পরে করোনাভাইরাসের কারণে তা সীমিত করা হয়েছে। আজ শুধু ঢাকায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একটি আলোচনা সভা ও জেলা কার্যালয়গুলোরে উদ্যোগে জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।