রাজধানীর রাস্তায় রাস্তায় ত্রাণের আশায় ঘুরে বেড়াচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। ফাঁকা রাস্তায় কোনো ব্যক্তিগত গাড়ি এসে থামলেই ঘিরে ধরছে তারা। কোনো কোনো গাড়ি এসে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু পণ্যসামগ্রী দিয়ে যাচ্ছে। হুড়োহুড়ি করে শক্তিমানেরা তা কেড়ে নিচ্ছে। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে অধিকাংশ মানুষই কিছুই পাচ্ছে না। আবার অনেকে নিজের বাড়িতে ব্যক্তিগতভাবে ত্রাণ দিতে গিয়ে মানুষের জটলা করছেন। সৃষ্টি হচ্ছে হাঙ্গামার। ব্যক্তিগতভাবে ত্রাণ না দিয়ে জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণের সরকারি নির্দেশনা থাকলেও কেউ তা মানছে না। জমায়েত করে ত্রাণ বিতরণের বিষয়টি নিরুৎসাহিত করছে সরকার। কিন্তু অতি উৎসাহীরা তা উপেক্ষা করছে। ফলে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সরকার ঘোষিত বন্ধের কারণে কর্মহীন মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ নিয়ে চারদিকে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা চলছে। ত্রাণের লাইনে হুড়োহুড়ি করে লঙ্ঘন করা হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব। দীর্ঘ ত্রাণের লাইন কিংবা হুড়োহুড়ি করে ত্রাণ নেওয়ার মাধ্যমে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে গেছে। এ অব্যবস্থাপনা রোধে সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, র্যাবের মাধ্যমে তালিকা করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রকৃত অভাবীদের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার দাবি উঠেছে। এর মাধ্যমে সমাজিক বিচ্ছিন্নতার মূল উদ্দেশ্য সফল হবে এবং যত্রতত্র ভিড় করে ত্রাণ নেওয়ার বিশৃঙ্খলা বন্ধ হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
সরকারি নির্দেশে দুই দফায় ১৭ দিনের বন্ধের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়েছে অসংখ্য মানুষ। দৈনিক আয়ের বিশেষ করে দিনমজুর, রিকশাচালক, স্বল্প আয়ের শ্রমিক-কর্মচারীসহ অসংখ্য মানুষ কষ্টে পড়ে গেছেন। তারাই রাজধানীর আবাসিক এলাকাগুলোয় ভিড় করছেন ত্রাণের আশায়। রাজধানীর উত্তরার কয়েকটি সেক্টরে ঘোষণা দিয়েও বিশৃঙ্খলার কারণে ত্রাণ বিতরণ বন্ধ করে দিতে হয়েছে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চালক জাকির হোসেন বলেন, ‘স্যার! বিকালে রাজলক্ষী মার্কেটের সামনে গাড়ি রাখছি। চারদিক থেকে অনেক মানুষ ঘিরে ধরেছে। তারা ভাবছে ত্রাণ নিয়ে আসছি। আসলেই মানুষ কষ্টে আছে।’
এদিকে ত্রাণ নিয়ে নানা অনিয়মের খবর আসছে বিভিন্ন স্থান থেকে। নওগাঁ প্রতিনিধি জানান, নওগাঁর রানীনগর উপজেলায় আওয়ামী লীগ নেতার গুদাম থেকে ভিজিডির ১৩৮ বস্তা চাল উদ্ধার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ওই আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িসংলগ্ন গুদাম থেকে এসব চাল উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার করা চালের পরিমাণ ৪ মেট্রিক টন। ওই আওয়ামী লীগ নেতার নাম আয়েত আলী। তিনি উপজেলার কালিগ্রাম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য। এলাকায় তার ধান-চালের আড়তের ব্যবসা আছে। ইউএনও আবদুল্লাহ আল মামুন, কালিগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম ও রানীনগর থানা পুলিশের উপস্থিতিতে খাদ্য অধিদফতরের সিল মারা ১৩৮টি চালের বস্তা জব্দ করা হয়। ঘটনার পর থেকে আয়েত আলী পলাতক।
নোয়াখালী প্রতিনিধি জানান, গতকাল ভোরে নোয়াখালী সদরে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ৬ বস্তা চালসহ এক ব্যক্তিকে আটক করে পুলিশে দিয়েছে জনতা। আন্ডারচর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাংলাবাজার থেকে রিকশাযোগে চালগুলো বিক্রির জন্য নিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় লোকজন আটক করে। পরে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে রিকশাচালকসহ চালগুলো জব্দ করে। ঘটনার পর অভিযুক্ত ডিলার মোসলেহ উদ্দিন পালিয়ে যান।
নেত্রকোনা প্রতিনিধি জানান, নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলার অধিকাংশ সরকারি কর্মকর্তা কর্মস্থলে না থাকায় চলতি করোনাভাইরাস মোকাবিলায় খাদ্য বিতরণে চরম দুর্ভোগ ঘটছে। উপজেলা ত্রাণ কর্মকর্তা (পিআইও) রাজীব আহমেদ জানান, খালিয়াজুরীতে বরাদ্দ ত্রাণ উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে ছয়জন সরকারি কর্মকর্তার উপস্থিতিতে কর্মহীন সহস্রাধিক পরিবারের মধ্যে দ্রুত বিতরণ করার কথা। কিন্তু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়, থানা, হাসপাতাল আর ব্যাংক ছাড়া প্রায় সবকটি সরকারি অফিস তালাবদ্ধ করে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মস্থলের বাইরে আছেন। ফলে ত্রাণ পাচ্ছে না অভাবী মানুষ।
ডিএনসিসির ত্রাণ বিতরণ : ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) রাজধানীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে অসহায় ও দুস্থ মানুষের মধ্যে জরুরি খাদ্যদ্রব্য বিতরণ অব্যাহত রেখেছে। ডিএনসিসি ৩১ মার্চ থেকে সব ওয়ার্ডে ২৮ হাজার ৫০০ দুস্থ পরিবারকে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করছে। ডিএনসিসির পক্ষ থেকে মিরপুরের টোলারবাগে কোয়ারেন্টাইন্ড ১ হাজার পরিবারকে ২৯ মার্চ খাদ্যদ্রব্য বিতরণ করা হয়। প্রতিটি পরিবারকে ৫ কেজি চাল, ২ কেজি আলু, ১ কেজি ডাল, ১ কেজি পিয়াজ, ১ লিটার তেল ও ১টি করে সাবান বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ওয়ার্ড কাউন্সিলররা নিজ উদ্যোগে এ পর্যন্ত প্রায় ১৮ হাজার অসহায় ও দুস্থ পরিবারের মধ্যে খাদ্যদ্রব্য বিতরণ করেন। তারা বিভিন্ন বস্তিতেও রান্না করা খাবার বিতরণ করেন।