রবিবার, ৩১ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

জাকির নায়েকের টাকা ও আন্তর্জাতিক সংযোগ

প্রতিদিন ডেস্ক

ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন (আইআরএফ) ও পিস টেলিভিশনের প্রতিষ্ঠাতা মুম্বাই নগরীর বহুল আলোচিত ধর্ম প্রচারক ডা. জাকির নায়েক ভারত থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্রায় ৪ বছর পর আবারও ‘সংবাদ’ হতে শুরু করেছেন। পত্রপত্রিকায় এবার তাকে ঘিরে যেসব প্রশ্ন উঠছে, তার মধ্যে রয়েছে : ‘এত টাকাকড়ি তিনি কোথা থেকে পান?’- ‘কী এমন আন্তর্জাতিক সংযোগ রয়েছে তার যে, তিনি কখনো তহবিলের অভাবে কাতর হন না?’। সাউথ কর্ণাটক সালাফি মুভমেন্ট এবং আল-লিসান ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মতো বেশকিছু উগ্রবাদী সংগঠনের সঙ্গে যোগসাজশ থাকায় জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালে মামলা ঠুকেছিল ভারতের ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি। বিপদ আঁচ করে ডা. জাকির পালিয়ে গেলেন। এখন যেসব ফেরারিকে ভারত সরকার পাকড়াও করার জন্য উতলা, জাকির তাদের অন্যতম। ভারত থেকে পালানোর পর এদেশ-ওদেশে চক্কর দিয়ে ডা. জাকির শেষতক মালয়েশিয়ায় খুঁটি গেড়েছেন। এখানে বসেই ইসলামের নাম ভাঙিয়ে উগ্রবাদের প্রচারণায় ব্যস্ত আছেন। কয়েক মাস আগে তিনি উগ্রবাদ সমর্থন না করায় মালয়েশীয় নেতাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার শুরু করেন। মালয়েশীয় সরকার তখন বলে, ‘চুপ! একদম চুপ! নইলে তোমায় বহিষ্কার।’ ব্যস, চুপ হয়ে গেলেন জাকির নায়েক।

উপসাগরীয় অঞ্চলের কতিপয় ধনপতির সঙ্গে জাকিরের দোস্তির খবর সম্প্রতি চাউর হয়েছে। জাকিরের কীর্তিকলাপ যারা পর্যবেক্ষণ করেন, এরকম কিছু বিশ্লেষক জানান, ডা. জাকির কিছুদিন আগে তাকে ৫ লাখ (মার্কিন) ডলার দেওয়ার জন্য কাতারের নাগরিক আবদুল্লাহ আলী আল এবাদিকে অনুরোধ জানান। কাতারের আরেক নাগরিক মুহাম্মদ সিদ্দিক আল-এবাদির সঙ্গে ডা. জাকিরের বেশ ঘনিষ্ঠতা। এই সুবাদে ওই দেশটির বেশ কিছু ধনী ব্যবসায়ী আর দাতব্য সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে জাকিরের। এদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করেন জাকির। তহবিলের টাকায় সৌদি আরব থেকে উর্দু ও ইংরেজিতে ‘পিস টিভি’র অনুষ্ঠান সম্প্রচারণার খরচা বহন করা হয়।

ঢাকায় ‘হলি আর্টিজান’ রেস্তোরাঁয় ২০১৬ সালের জুলাইতে সন্ত্রাসী হামলার পর জানা গেছে নৃশংস এই ঘটনায় জড়িত সন্ত্রাসীদের মধ্যে নাবরিস ইসলাম ও রোহান ইমতিয়াজ নামে দুজন টেলিভিশনে জাকির নায়েকের ভাষণ শুনে শুনে উগ্রপন্থার অনুরাগী হয়েছিল। হলি আর্টিজান হত্যাকান্ডের পরপরই জাকির নায়েকের পিস টিভির সম্প্রচার বাংলাদেশ ও ভারতে নিষিদ্ধ করা হয়। বাংলাদেশ সরকার আরও কঠোর হয় এবং ইসলামী মোবাইল হ্যান্ডসেট নামে জাকিরের বিপণনকৃত মোবাইল ফোন সেট আমদানি নিষিদ্ধ করে।

পশ্চিমা পত্রপত্রিকার খবরে বলা হয়, জাকির নায়েক খুব সূক্ষ্মচালে নিরীহ আলিম সেজে টেলিভিশন ও অন্যান্য মাধ্যমে ধর্মমাহাত্ম্য প্রচার করেন যার মর্মবাণী হলো, ‘উগ্রপন্থার প্রয়োগ ব্যতিরেকে শান্তি ও ন্যায়বিচার অসম্ভব।’ তার এসব বোলচালে ভারত ও অন্যান্য দেশের অনেক তরুণ প্রভাবিত হয়। এদেরই কেউ কেউ ‘দায়েশ’ এর মতো চরমপন্থি বিভিন্ন সংগঠনে যোগ দেয়।

যোগদানের ৫টি দৃষ্টান্ত পাওয়া গেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। যেমন : (এক) ভারতের কেরালা রাজ্যে জাকির নায়েকের পিস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে চাকরি করার সময় আবদুর রশিদ ও তার স্ত্রী ইয়াসমিন উগ্রপন্থায় দীক্ষিত হন। এরপর রশিদ নিজেই প্রচারকের ভূমিকা নেন। স্থির করেন যে, ‘দায়েশ’-এ যোগ দিতে দেশ ছেড়ে আফগানিস্তান রওনা হবেন। এজন্য তিনি ২৩ ব্যক্তির একটি গ্রুপও করে ফেললেন।

(দুই) আইসিস-এর আদর্শভিত্তিক সংগঠন জুনুদ-উল খিলাফাফিল হিন্দ (জে কে এইচ) সংগঠনের মধ্যমণি ইবরাহিম ইয়াজদানি ও আইয়াস ইয়াজদানি। জাকির নায়েকের বক্তৃতায় অনুপ্রাণিত হয়ে তারা ভারতের বিভিন্ন এলাকায় সন্ত্রাসী হামলা চালানোর চক্রান্ত করে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ২০১৬ সালের জুলাইতে ওদের নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে।

(তিন) জাকির নায়েকের প্রচারণায় মন-মানসিকতার আমূল পরিবর্তন ঘটেছিল নাসের আবুবকর ইয়াফাহির। এক পর্যায়ে ইয়াফাহি যোগ দেন জে কে এইচ সংগঠনে। কিন্তু ‘কাজ’ শুরু করার সুযোগ পাননি। ২০১৬ সালের জুলাইতে ধরা পড়েন নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে।

(চার) জাকির নায়েকের ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন রাজস্থানের যুবক আবু আনাসকে ‘সাধ মেটানোর জন্য’ থোক বরাদ্দ মঞ্জুর করে। আনাসের সাধ ছিল সিরিয়া গিয়ে আইসিস যোদ্ধা হওয়া। তিনি আইসিসে যোগ দিতে রওনাও হন। কিন্তু ভারত ছাড়ার আগেই তাকে গ্রেফতার করা হয়।

(পাঁচ) আফশা জাবিন ওরফে নিকি যোশেফ। ভারতীয় এই নারী দুবাইতে চাকরি করতেন। জাকির নায়েকের প্রচারণায় প্রভাবিত হয়ে তিনি ‘সেবক’ হয়ে গেছেন। আইসিসের জন্য লোকজন বাছাই করে যোদ্ধা নির্বাচনের ব্যাপারে সক্রিয় সহযোগিতা দিতেন আফশা জাবিন। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে দুবাই কর্তৃপক্ষ তাকে ভারতে পাঠিয়ে দেয়। ‘ফেরারি জাকির নায়েক অসাড় হয়ে ঘুমোচ্ছেন’- এরকম সন্তুষ্টিতে না ভোগার পরামর্শ দিচ্ছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তারা জানান, কাতার, আরব আমিরাতসহ উপসাগরীয় কয়েকটি দেশে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে জাকির নায়েক তহবিল সংগ্রহ করে চলেছেন। এই টাকায় তিনি তার সাগরেদদের পুষছেন আর সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক সজীব রাখছেন।

সর্বশেষ খবর