কয়েকটি নদ-নদীতে পানির উচ্চতা কমতে শুরু করলেও বানভাসির দুর্ভোগ কমছে না। পানি না নামায় এখনো ডুবে আছে অধিকাংশ বন্যাকবলিত এলাকা। এখনো পানিবন্দী লাখ লাখ মানুষ। অব্যাহত ভাঙনে বিলীন হচ্ছে ঘরবাড়ি-ফসলি জমি। তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, ওষুধ ও পশু খাদ্যের। চুলা ডুবে যাওয়ায় নেই রান্নার ব্যবস্থা। গবাদিপশু, হাঁস-মুরগির সঙ্গে গাদাগাদি করে বাস করতে হচ্ছে উঁচু সড়ক, আশ্রয় কেন্দ্র ও বাঁধে আশ্রয় নেওয়া বানভাসিকে। অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে বসবাস ও দিনের পর দিন বন্যার পানির সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে নানারকম রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। প্রতিদিনই বন্যার পানিতে ডুবে কারও না কারও মৃত্যুর খবর আসছে। গতকালও জামালপুর ও কুড়িগ্রামে চার শিশুসহ চারজন বন্যার পানিতে ডুবে প্রাণ হারিয়েছেন। এরমধ্যেই আজ থেকে আবার ভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। এতে ফের বৃদ্ধি পেতে পারে নদ-নদীর পানি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, গতকাল সকালে ১০১টি পানি সমতল স্টেশনের ৪১টিতে পানি বৃদ্ধি পায়। হ্রাস পায় ৫৯টিতে। অপরিবর্তিত ছিল একটি। এ ছাড়া ১৩টি নদ-নদীর পানি ২২টি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পাউবোর পূর্বাভাসে বলা হয়, আজকের মধ্যে সিলেট, সুনামগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও মানিকগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। তবে অবনতি হতে পারে মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী ও ঢাকা জেলার নিম্নাঞ্চলে। এ ছাড়া পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় আজকের মধ্যে জামালপুর পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদীগুলোর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে। স্থিতিশীল আছে গঙ্গা-পদ্মা নদীগুলোর পানি সমতল। তবে আজ থেকে তা হ্রাস পেতে পারে।
আমাদের বিভিন্ন জেলার সংবাদকর্মীরা জানিয়েছেন বন্যার সর্বশেষ পরিস্থিতি। জামালপুর : যমুনার পানি ধীরগতিতে কমতে শুরু করলেও দ্রুতগতিতে বাড়ছে ব্রহ্মপুত্র, ঝিনাইদহ শাখা নদীর পানি। গতকাল বিকালে বাহাদুরাবাদঘাট পয়েন্টে যমুনার পানি বিপৎসীমার ১০৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে ও ব্রহ্মপুত্রের পানি জামালপুর পয়েন্টে বিপৎসীমার ১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ফলে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিতই রয়েছে। গতকাল বন্যার পানিতে ডুবে জামালপুর সদরের লক্ষ্মীরচর ইউনিয়নে সাদিয়া আক্তার (১০) এবং দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বাহাদুরাবাঘাট ইউনিয়নে সাঁজু মিয়া (৭) নামে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জামালপুর সদরের লক্ষ্মীরচর, তুরশীরচর ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়াও ঝিনাই, জিঞ্জিরামসহ শাখা নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। জামালপুর জেলা প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী জেলার সাত উপজেলা ও আট পৌরসভার ৬৫৩টি গ্রামের ২ লাখ ৩০ হাজার ৪২১ পরিবারের ৯ লাখ ৩১ হাজার ৫৩৭ জন মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে ৩ হাজার ৩২১টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে ৭৯টি আশ্রয় কেন্দ্রে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৬০ কিলোমিটার কাঁচা-পাকা সড়ক। দুর্গতদের জন্য নতুন করে ১০০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ দেড় লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
কুড়িগ্রাম : বন্যার পানিতে ডুবে গত ২৪ ঘণ্টায় কুড়িগ্রামে ৩ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এদের মধ্যে দুই শিশু ও একজন গ্রামপুলিশ সদস্য। তারা হলেন- বায়েজিদ (৮), মুন্নি (১৮ মাস) ও গ্রামপুলিশ সদস্য সুরুজ্জামান (৪৫)। জেলা সিভিল সার্জন ডাক্তার হাবিবুর রহমান জানান, চলতি দ্বিতীয় দফা বন্যায় পানিতে ডুবে শিশুসহ ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া প্রথম দফার বন্যায় পানিতে ডুবে আরও ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। মানিকগঞ্জ : ২৪ ঘণ্টায় ৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে গতকাল যমুনার পানি আরিচা পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। প্রবল স্রোতের কারণে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে ফেরি চলাচলে সময় লাগছে দ্বিগুণ। ফলে পাটুরিয়া প্রান্তে দীর্ঘ হচ্ছে যানবাহনের সারি। অপরদিকে মাওয়া-কাওড়াকান্দী রুটের গাড়ি এ পথে আসায় যানবাহনের চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে ১৮টি ফেরির মধ্যে মাত্র ১২টি ফেরি দিয়ে যানবাহন পারাপার করা হচ্ছে। ফলে পাটুরিয়া ঘাটে শত শত যানবাহন পারাপারের অপেক্ষায় রয়েছে। চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা। বগুড়া : বগুড়ার শেরপুরে বাঙালি ও করতোয়া নদীর পানি বেড়েই চলেছে। এতে উপজেলার দুটি ইউনিয়নের ১৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া পৌরসভার দুটি ওয়ার্ডের শতাধিক বাড়িঘরেও বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। ঘরবাড়ি ছেড়ে বানভাসি অনেক মানুষ স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছেন। আবার অনেকেই নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছেন। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় কয়েকশ বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। পানিবন্দী হয়ে পড়া পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বন্যায় উঠতি ফসল রোপা-আউশ ধান ডুবে যাওয়ায় চাষিরা মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। বন্যাকবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি গবাদিপশুর খাদ্যের সংকট দেখা দেওয়ায় চরম বিপাকে পড়েছেন ওইসব মানুষ। এ ছাড়া বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার জোড়গাছা, মধুপুর, পাকুল্লা ও তেকানীচুকাইনগর ইউনিয়নের ৫ হাজার ৪৩৭টি পরিবারের প্রায় ২৪ হাজার ৩৭৫ জন মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছেন।
চাঁদপুর : বন্যার পানির প্রবল স্রোতে বৃদ্ধি পেয়েছে নদী ভাঙন। সদর উপজেলার রাজরাজেশ্বর ইউনিয়নে নব-নির্মিত সাইক্লোন শেল্টারটি মেঘনার ভাঙনের মুখে রয়েছে। দৃষ্টিনন্দন তৃতীয়তলাবিশিষ্ট রাজরাজেশ্বর ওমর আলী স্কুল কাম সাইক্লোন শেল্টারটি মাসখানেক আগে কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। কয়েক দিন ধরে অব্যাহত ভাঙনের মুখে শতাধিক বসতবাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে আরও বেশ কিছু বাড়িঘর ভাঙন হুমকিতে রয়েছে।
সিরাজগঞ্জ : বন্যাকবলিত এলাকায় রোগবালাই বাড়ছে। দিনের পর দিন কাদাপানিতে বসবাসের কারণে হাত-পায়ে ঘা, ডায়রিয়াসহ নানা রোগে ভুগছেন বন্যাকবলিতরা। একদিকে আয়-রোজগার নেই, অন্যদিকে পানিবন্দী থাকায় সঠিকভাবে চিকিৎসা করাতে পারছে না। কাওয়াকোলা ইউপির আয়েশা ও রমিছা বেগম জানান, চরাঞ্চলের কোথাও উঁচু জায়গা নেই। কোথাও উঁচু থাকলেও স্যাঁতসেঁতে অবস্থা। এ জন্য হাত-পায়ে ঘা দেখা দিয়েছে। রাতে হাত-পায়ের চুলকানি ও জ¦ালায় ঘুমাতে পারি না। নওগাঁ : জেলার মান্দা উপজেলার শিবনদের বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের টেংরার ভাঙন স্থান দিয়ে হু হু করে পানি প্রবেশ করছে। ভাঙন স্থানটি এখন লাখো মানুষের মরণ ফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পানির প্রবল চাপে তলিয়ে গেছে খেতের ফসল। ভেসে গেছে বিল, জলাশয় ও পুকুরের মাছ। নদের বিপরীত তীরে মাত্র শতাধিক বিঘা জমির ফসল বাঁচাতে ও বছর ধরে মাছ শিকারের লোভে কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ বারবার কেটে দিচ্ছে বাঁধটি। এতে প্রতিবছর কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন দুর্গত ১২ ইউনিয়নের মানুষ।