বৃহস্পতিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

৭ বছর পর মিলল সাড়ে ৩ কোটি টাকা চুরির চাঞ্চল্যকর তথ্য

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত পাপুয়া নিউগিনির নাগরিকের ভিসা কার্ড হ্যাক

মাহবুব মমতাজী

পাপুয়া নিউগিনির ব্যাংকের ভিসা কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা চুরি হয় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, বাংলাদেশসহ ৯টি দেশে। ৮টি দেশের কেউই সেই ভয়ংকর চোরকে খুঁজে পায়নি। এই চোর ধরে অসাধারণ সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত পাপুয়া নিউগিনির নাগরিক আবদুল ওয়াহেদের সাড়ে ৩ কোটি টাকা চুরি করে সেই জালিয়াত। তদন্তে তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেই হ্যাকারকে খুঁজে বের করে ফেলল বাংলাদেশ পুলিশ। আবদুল ওয়াহেদের ভিসা কার্ড হ্যাক হয় ২০১৪ সালে। চুরি করা টাকা কেনাকাটায় শেষ করে হ্যাকার। ৮ মাসের তদন্তে হ্যাকার নাজমুস সাকেব নাঈমের খোঁজ পায় রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা পুলিশ। গত ২৫ আগস্ট মিরপুর ডিওএইচএস এলাকা থেকে নাঈম ও তার সঙ্গী মইনুল ইসলাম মামুনকে গ্রেফতার করা হয়। ৫ দিনের রিমান্ড শেষে গত ১ সেপ্টেম্বর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হ্যাক করে টাকা চুরির তথ্য জানিয়েছেন নাঈম। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) হারুন অর রশীদ এ প্রতিবেদককে জানান, পাপুয়া নিউগিনির ব্যাংক সাউথ প্যাসিফিক লিমিটেডে অ্যাকাউন্ট করেছিলেন আবদুল ওয়াহেদ। ২০১৪ সালের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত তার ইন্টারন্যাশনাল ভিসা কার্ড জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। তার ৮০ দিনের ব্যাংক স্টেটমেন্ট সংগ্রহ করে দেখি যে- হ্যাকার থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশে বসে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশসহ আরও ৫টি দেশে অনলাইনে ১৪৭২টি ট্রানজেকশনের মাধ্যমে কেনাকাটা করেন। সেই হ্যাকারকে গ্রেফতারের সময় তার কাছ থেকে জব্দ ল্যাপটপ ও ৩টি ই-মেইলে হ্যাকিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে। হ্যাকার নাজমুস সাকেব নাঈম আমেরিকার ‘দি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি’ থেকে কম্পিউটার সাইন্সে গ্র্যাজুয়েশন করেন। তিনি আইটি এক্সপার্ট ও ভালো প্রোগ্রামার। আন্তর্জাতিক বিষয় হলেও দেশের ভাবমূর্তির কথা চিন্তা করে মামলাটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত আমরা সফল হয়েছি। 

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ভুক্তভোগী ওয়াহেদ বাংলাদেশ ছাড়া বাকি দেশগুলোতে আইনি সহায়তা চেয়ে ব্যর্থ হন। ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে ১৯৮৮ সালে পাপুয়া নিউগিনিতে পাড়ি জমান আবদুল ওয়াহেদ। সেখানে প্রথমে শিক্ষকতা করলেও পরে ব্যবসা শুরু করেন। এখন তিনি সেখানকার শীর্ষস্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘দেশ বেশ এন্টারপ্রাইজ’ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ২০১৪ সালের অক্টোবরের শেষ দিকে ব্যবসায়িক কাজে সিঙ্গাপুরে যান তিনি। কাজ শেষে সিঙ্গাপুরের পার্করয়েল হোটেলের বিল পরিশোধ করতে গেলে বলা হয় তার ইন্টারন্যাশনাল ভিসা কার্ডটি রেস্ট্রিকটেড করা হয়েছে। নিজের কাছে থাকা নগদ টাকা ও পরিচিতজনের সহায়তায় বিল পরিশোধ করে পাপুয়া নিউগিনি ফিরে যান তিনি। যোগাযোগ করেন ব্যাংক সাউথ প্যাসিফিক লিমিটেড কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রতারণামূলক বৈদেশিক লেনদেন সন্দেহে তার কার্ডটি রেস্ট্রিকটেড করা হয়েছে। ওই বছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আবদুল ওয়াহেদের ভিসা কার্ড ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, হংকং, চীন, থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশে অনলাইনে টাকা খরচ করা হয়েছে। ব্যাংকের এই বক্তব্য দায়সারা মনে হলে ক্ষতিপূরণ দাবি করে ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করেন ওয়াহেদ। ব্যাংক কর্তৃপক্ষও পাল্টা মামলা করে তার বিরুদ্ধে। ব্যাংকের অভিযোগ ছিল- কার্ডের তথ্য পাচার করে ওয়াহেদ নিজে অথবা তার কর্মচারী কিংবা আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে টাকাগুলো খরচ করেছেন। ক্ষতিপূরণ আদায়ের পাশাপাশি ব্যাংকের অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করতে আইনি লড়াই শুরু করেন ওয়াহেদ। যেসব দেশে তার কার্ড দিয়ে লেনদেন হয়েছে আইনজীবীর মাধ্যমে সেসব দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা চান। কিন্তু ব্যর্থ হন তিনি। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে আসেন ওয়াহেদ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায়। মামলা তদন্তে দেখা যায়- ওই কার্ড ব্যবহার করে অনলাইনে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ৯টি দেশ থেকে দামি সফটওয়্যার, অ্যাপলের ম্যাকবুক, আইফোন কেনেন সাকেব। পাশাপাশি নিজের ‘ইন্ট্রোপে’ অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ভার্চুয়াল ভিসা কার্ড জেনারেট করে ৬৯ বারে প্রায় ৯৯ হাজার মার্কিন ডলার তুলে নেন। আর ‘নেটাললার্ক’ অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে আরেকটি ভার্চুয়াল ভিসা কার্ড জেনারেট করে ৭ বারে প্রায় ১ হাজার মার্কিন ডলার হাতিয়ে নিয়েছেন।

পুলিশ জানায়, সাকেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন সিভিল ব্যাংক নেপালের পরামর্শক হিসেবে। তার উদ্ভাবিত দিজেডবয় নিয়ে মার্কিন সাময়িকী অন্ট্রপ্রেনার ও ফোবর্সে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে সাকেব জানিয়েছেন, হ্যাক করা কার্ড ব্যবহার করে প্রথমে তিনি দেশীয় কিছু অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে প্লাটফর্মে ১৬টি দামি মোবাইলফোন কেনেন। ২০১৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর থাই এয়ারওয়েজে স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, শ্যালিকা ও শাশুড়িকে নিয়ে থাইল্যান্ডে যান। তার পরিবারের সদস্যরা কেনাকাটা ও ঘোরাঘুরিতে ব্যস্ত থাকলেও হোটেল রুমেই অবস্থান করে অনলাইন শপিংয়ে ব্যস্ত থাকেন। একদিনে ১০০টির বেশি লেনদেন করেন। তার আগে ২ সেপ্টেম্বর একই এয়ারলাইনসের বিজনেস ক্লাসের ৬টি টিকিট কনফার্ম করেও যাননি তিনি। সাকেবের তৈরি ‘পেখম’ অনলাইনে হোটেল বুকিংয়ের জন্য বিকাশ, শেবা ডট এক্সওয়াইজেড, ওয়ানব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, সার্কেল ফিনটেকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। পেমেন্ট গেটওয়ে সার্ভিস প্রোভাইডার ইজিপেওয়ে-এর প্রতিষ্ঠাতা তিনি। একইসঙ্গে ব্লকবাস্টার সিনেমাজ ও সিলভার স্ক্রিন সিনেপ্লেক্সের ডিজিটাল টিকিট ব্যবস্থার রূপকার।

সর্বশেষ খবর