রবিবার, ৩ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

তুরাগ-বুড়িগঙ্গার প্রশ্নবিদ্ধ সীমানা পিলার

বুড়িগঙ্গায় ৩১২ ও তুরাগে ১১১১ পিলার নিয়ে বিতর্ক, বর্ষাকালে তলিয়ে যায়

শামীম আহমেদ

তুরাগ-বুড়িগঙ্গার প্রশ্নবিদ্ধ সীমানা পিলার

ঢাকার চার পাশের নদ-নদী দখলদারদের হাত থেকে রক্ষা করতে এখন পর্যন্ত বসানো ৩ হাজার ৮৪টি সীমানা পিলারের মধ্যে ১ হাজার ৪২৩টিই প্রশ্নবিদ্ধ। অভিযোগ উঠেছে, এসব পিলার আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ফোরশোর বা নদীর মধ্যেই স্থাপন করা হয়েছে, যা নদী উদ্ধারের পরিবর্তে দখলের সুযোগ আরও পাকাপোক্ত করেছে। এর মধ্যে বুড়িগঙ্গা তীরে রয়েছে ৩১২টি ও তুরাগ তীরে ১ হাজার ১১১টি। বর্ষা মৌসুমে এসব সীমানা পিলার ছাড়িয়ে যাচ্ছে নদীর পানি।

বুড়িগঙ্গা ও  তুরাগ নদের সীমানা পিলার স্থাপন নিয়ে রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) জরিপে এ চিত্র উঠে এসেছে। গতকাল প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকার চারপাশের নদীগুলোকে রক্ষায় ঢাকা বন্দর এলাকায় ৩ হাজার ৮৪টি সীমানা পিলার বসানো হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৪২৩টি পিলার ফোরশোর অথবা নদীর মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে। বুড়িগঙ্গা নদীতে ৩১২টি পিলার ভুলভাবে স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে পশ্চিম প্রান্তে ২২৮টি আর পূর্ব প্রান্তে ৮৪টি। তুরাগ নদে ১ হাজার ১১১টি পিলার ভুলভাবে স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে পশ্চিম প্রান্তে ৭০২টি ও পূর্ব প্রান্তে ৪০৯টি। বর্ষা মৌসুমে বা নদীর পানি বাড়লে এসব পিলারের অনেকটা ডুবে যাচ্ছে। এগুলোর বাইরে বেড়িবাঁধেও ৩৯০টি বিতর্কিত পিলার পাওয়া গেছে। এগুলোর কোনোটি বেড়িবাঁধের ঠিক ওপরে যেখানে কখনই নদীর পানি আসে না, আবার কোনোটি বেড়িবাঁধের একেবারে ২০-৩০ ফুট নিচে বসানো হয়েছে। গত অক্টোবরে বুড়িগঙ্গা এবং তুরাগের আশুলিয়া ল্যান্ডিং  স্টেশন পর্যন্ত প্রায় ৩৭ কিলোমিটার এলাকা সরেজমিন ঘুরে প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে। ভুলভাবে স্থাপিত এসব পিলার দখলদারদের পক্ষে যাবে বলে মনে করে সংস্থাটি।

গবেষণা সংস্থাটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরেজমিন পর্যবেক্ষণ, বিভিন্ন মৌসুমে তোলা পিলারের ছবি, জিপিএস সার্ভে, গুগল আর্থ স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে। ২০০৯ সালে হাই কোর্টের রায়ে ঢাকার চার নদীর দখলদারদের উচ্ছেদ করে নদীগুলোকে টেকসইভাবে সীমানা পিলার তৈরির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। তখন বুড়িগঙ্গা এবং তুরাগে প্রায় ৬ হাজার পিলার স্থাপন করা হয়। তখনো অধিকাংশ পিলার নদীতে কিংবা প্লাবনভূমিতে স্থাপন করা হয়। বিতর্কের মুখে টাস্কফোর্সের মিটিংয়ে একজন ডেপুটি সেক্রেটারির নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটি ২০১৪ সালে যে রিপোর্ট দাখিল করে, সেখানেও বলা হয়, স্থাপন করা পিলারের অধিকাংশই ভুলভাবে স্থাপিত হয়েছে। দ্বিতীয় দফায়ও একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটল। সবশেষ বর্ষায়ও আমরা অনেক পিলার পানির মধ্যে দেখেছি। অথচ পোর্ট রুল ১৯৬৬ ও বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩ তে নদী ও ফোরশোর একসঙ্গে রক্ষা করার কথা বলা হয়েছে। দেশের নদ-নদী সুরক্ষায় আমাদের প্রধানমন্ত্রী থেকে দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় সোচ্চার, সেখানে কিছু  লোকের দায়িত্বহীনতার কারণে গুরুত্বপূর্ণ এই কাজটি সঠিকভাবে হচ্ছে না। তবে বর্তমান স্থান থেকে পিলারগুলো সরিয়ে সঠিক স্থানে বসানোর এখনো সুযোগ রয়েছে।

নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানি যত নিচে যায় সেখান থেকে বর্ষা মৌসুমে বা জোয়ারে সর্বোচ্চ যতদূর পর্যন্ত পানি ওঠে (সর্বোচ্চ পানিসীমা) ততটুকুই ফোরশোর। আর বন্দর এলাকায় সর্বোচ্চ পানিসীমার সঙ্গে ৫০ মিটার যোগ করার পর যে সীমানা দাঁড়াবে সেখানে পিলার স্থাপন করতে হবে। এর ভিতরে করা যাবে না। আর যেখান দিয়ে নৌযান চলে না সেখানে সর্বোচ্চ পানিসীমার সঙ্গে ১০ মিটার যোগ করার পর সীমানা পিলার বসাতে হবে। তবে পিলার বসানো নিয়ে অভিযোগ আমরাও পেয়েছি। দীর্ঘদিনের দখলে-দূষণে মৃতপ্রায় ঢাকার চার নদীকে দখল ও দূষণমুক্ত করে স্বচ্ছ পানি প্রবাহ ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি নদীর দুই পাড় দৃষ্টিনন্দন করতে সরকার স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। এর অংশ হিসেবে ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি ঢাকার আশপাশের নদ-নদী দখলমুক্ত করার অভিযানে নামে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। ৬ মাসে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও বালু নদীর উভয় পাড়ের ১৫৭ কিলোমিটার তীরভূমিতে অভিযান চালিয়ে ৪ হাজার ৭৭২টি ছোট-বড় স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। উদ্ধার হয় ১২১ একর তীরভূমি। পাশাপাশি প্রায় সাড়ে ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর তীরভূমিতে ১০ হাজার ৮২০টি সীমানা পিলার স্থাপন, ৫২ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে, সীমানা প্রাচীর, ইকোপার্কসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে প্রকল্প নেওয়া হয়। ২০২২ সালের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হওয়ার কথা থাকলেও মাঝপথেই সীমানা পিলার নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

সর্বশেষ খবর