রবিবার, ৩ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

সাত বছর পর জানা গেল চাচাতো ভাই খুনি

মাহবুব মমতাজী

ভোর তখন সাড়ে ৪টা। হঠাৎ চিৎকার দিয়ে উঠে পাঁচ বছর বয়সী কুলছুমা খাতুন। তার চিৎকার শুনে পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে বাবা কালাম মিয়া ও মা সাজেদা খাতুন। কুলছুমা আর তার বড় বোন ফাতেমা খাতুন (১৩) এক ঘরেই ঘুমায়। রাতে ফাতেমাকে দেখতে না পেয়ে চিৎকার করে উঠে কুলছুমা।

এ ঘটনা ২০১৪ সালের ৮ মার্চের। ঘটনাটি ঘটে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার জয়পুর গ্রামে। ছোট মেয়ের চিৎকার শুনে কালাম ও সাজেদা দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে দেখেন তাদের বড় মেয়ে ফাতেমা গলায় ফাঁস নিয়ে ঝুলে আছে। এ দৃশ্য দেখার পর তারাও চিৎকার করে উঠলে আশপাশের লোকজন এসে জড়ো হয় তাদের বাড়িতে।

বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে পীরগঞ্জ থানায় অবহিত করলে সেখানে একটি অপমৃত্যু মামলা হয়। মামলা নম্বর-৫। পরে পুলিশ লাশ ময়নাতদন্তের জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। পরিবারের সবার ধারণা- ফাতেমা আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু আত্মহত্যার কারণ কেউই জানতেন না।  ঘটনার প্রায় দেড় মাস পর ঘটনার নতুন মোড় নেয়। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে দেখা যায় ফাতেমা অন্তঃসত্ত্বা ছিল এবং সে আত্মহত্যা করেনি, তাকে হত্যা করা হয়েছে। রহস্য উদঘাটনে মাঠে নামে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। থানা পুলিশ ওই বছরের ২১ এপ্রিল ফাতেমার বাবা কালাম মিয়ার কাছ থেকে আরেকটি মামলা নেয়। মামলায় তিনি উল্লেখ করেন যে, তার মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা ছিল। সে স্থানীয় টি এম ফাজিল মাদরাসার নবম শ্রেণির ছাত্রী। তার গর্ভধারণের বিষয়ে সে কাউকে কিছুই বলেনি। তবে তাকে বেশির ভাগ সময় মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখা যেত। কারও সঙ্গে প্রেম পরবর্তী দৈহিক সম্পর্ক হয়েছে এবং যার কারণে সে অন্তঃসত্ত্বা হয়। কৌশলে শ্বাসরোধে হত্যার পর তার লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়। তদন্তে নেমেও পুলিশ অন্ধকারেই থেকে যায়। কারণ ফাতেমার অন্তঃসত্ত্বার বিষয়ে তার পরিবারের কেউই কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য তাদের দিতে পারছিলেন না। থানা পুলিশও রহস্য উদঘাটন করতে পারছিল না। পরে ওই মামলার তদন্তভার পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) স্থানান্তরের জন্য গত বছর পুলিশ সদর দফতরে চিঠি লিখে পীরগঞ্জ থানা। গত বছরের ১৩ মে মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে সিআইডি।

সংস্থাটির ডিআইজি শেখ নাজমুল আলম এ প্রতিবেদককে জানান, মামলাটির তদন্তভার নেওয়ার পরই তাদের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। ঘটনাটি ছিল ক্লু-লেস। শুরুতেই তাদের সন্দেহ হয় যে আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কেউ ঘটনাটি ঘটাতে পারে।

প্রায় সাত বছর পর ফাতেমার মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করে সিআইডি। তদন্তে নেমেই সংস্থাটির কর্মকর্তারা গত বছরের ২০ অক্টোবর সন্দেহভাজন সাতজনের ডিএনএ পরীক্ষা করে। এদের ডিএনএ পরীক্ষার পর জানা যায়- ফাতেমার গর্ভের সন্তানের বাবা তারই আপন চাচাতো ভাই হাসানুর জামান শিপন ওরফে টেক্কা (৩৩)। গত ১৫ ডিসেম্বর রংপুরে পীরগঞ্জে অভিযান চালিয়ে টেক্কাকে গ্রেফতার করে সিআইডি। তদন্ত কর্মকর্তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ফাতেমা হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে টেক্কা।

শেখ নাজমুল আলম বলেন, ফাতেমার সঙ্গে টেক্কার সম্পর্ক ছিল। তাকে হত্যার কিছু দিন আগে অন্য আরেকটি মেয়ে বিয়ে করে টেক্কা। ঘটনার দিন ফাতেমার রুমে ঢুকে তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করে।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ফাতেমা এবং টেক্কাদের বাড়ি মুখোমুখি। ফাতেমা বড় হওয়ার পর টেক্কা মাঝেমধ্যে তাকে বিভিন্ন জিনিসপত্র কিনে দিত। এ রকম করতে করতে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা হয়। আর দুপুরে ফাতেমাদের বাসায় কেউ থাকত না। সুযোগ পেয়ে এক দিন তাদের বাসায় গিয়ে ফাতেমাকে ধর্ষণ করে টেক্কা। এরপর থেকে মাঝে-মধ্যেই দুপুরে তাদের বাসায় তার যাওয়া-আসা ছিল।

সর্বশেষ খবর