শনিবার, ১০ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

মেঝের রক্ত ধুয়েমুছে আলামত নষ্ট করেন স্বামী সাকিব

গুলশানে গৃহবধূ ঝিলিক হত্যা

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর গুলশান-২ নম্বরে শ্বশুরবাড়িতে গত ২ এপ্রিল রাতে স্বামীর মারধরে গৃহবধূ হাসনা হেনা ঝিলিকের (২৩) মৃত্যু হয়। পুলিশের তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঝিলিকের স্বামী সাকিব আলম তার ভাই ও ভাইয়ের স্ত্রীর সহায়তায় বিছানার চাদর ও মেঝের রক্ত ধুয়ে আলামত নষ্ট করে ফেলেন। ঝিলিকের শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর ও জা-এর পরিকল্পনায় পরদিন সকালে ঝিলিকের লাশ তাদের ব্যক্তিগত গাড়িতে হাতিরঝিলে নিয়ে সড়ক দুর্ঘটনার নাটক সাজান সাকিব। 

গৃহবধূ ঝিলিক হত্যা মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন তার স্বামী সাকিব আলম (৩৮), শ্বশুর জাহাঙ্গীর আলম (৬২), শাশুড়ি সাঈদা আলম (৫৮)। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঝিলিকের স্বামী সাকিবকে দ্বিতীয় দফায় দুই দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

গতকাল তাকে দ্বিতীয় দফার রিমান্ডে প্রথম দিনের মতো জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। এদিকে ঝিলিকের শ্বশুর জাহাঙ্গীর আলম, শাশুড়ি সাঈদা আলম কারাগারে আটক রয়েছেন। গতকাল ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী সাংবাদিকদের বলেন, তদন্তে বেরিয়ে এসেছে এটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। এতে হাসনা হেনা ঝিলিকের স্বামীসহ এজাহারভুক্ত পাঁচজনেরই সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তবে গ্রেফতার সাকিব ও তার মা-বাবা হত্যাকান্ডের বিষয়ে এখনো মুখ খোলেননি। এজাহারভুক্ত আসামি হাসনা হেনা ঝিলিকের দেবর ফাহিম আলম ও জা          টুকটুকি আক্তার করোনায় আক্রান্ত থাকায় ওই বাড়িতে তাদের পুলিশি পাহারায় রাখা হয়েছে।

গত ৮ এপ্রিল ঢাকা মহানগর হাকিম শাহিনুর রহমান সাকিব আলম মিশুকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আরও দুই দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ দেন। এর আগে তাকে তিন দিনের রিমান্ড শেষে আদালতে হাজির করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। এরপর মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে আবারও ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন।

৩ এপ্রিল ঝিলিককে হত্যার অভিযোগ এনে গুলশান থানায় মামলা করেন তার মা তহমিনা হোসেন আসমা। মামলায় আসামি করা হয়- ঝিলিকের স্বামী সাকিব আলম মিশু, দেবর ফাহিম আলম, শাশুড়ি সাঈদা আলম, শ্বশুর জাহাঙ্গীর আলম এবং বাসার ম্যানেজার আশিষকে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২ এপ্রিল রাত ১০টায় সাকিব ও ঝিলিকের মধ্যে তর্ক হয়। সাকিব তার ৯ মাস বয়সী শিশু ছেলের সামনে ঝিলিককে কিল, ঘুষি ও লাথি মারেন। আর্তনাদ ও চিৎকার শুনে তাদের বাসার দুই গৃহকর্মীসহ সাকিবের মা-বাবা, ভাই ও জা ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেন সাকিব একের পর এক ঝিলিককে আঘাত করছেন। এ সময় ফাহিম তার বড় ভাই সাকিবকে সরিয়ে দেন। তখন ঝিলিক প্রায় অচেতন। কিন্তু কেউই তাকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠাননি কিংবা ঝিলিকের বাড়িতে খবর পাঠাননি। এ সময় তারা ঝিলিকের মুখে জুস ও পানি ঢাললেও তা গড়িয়ে পড়ছিল। এক পর্যায়ে ঝিলিককে রেখে তার শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর ও জা ঝিলিকের ৯ মাসের শিশুকে তাদের ঘরে নিয়ে যায়। রাতে ঝিলিকের ঘরেই তার স্বামী সাকিব ছিলেন। এরপর সাকিব ভাই ও ভাইয়ের স্ত্রীর সহায়তায় বিছানার চাদর ও মেঝের রক্ত ধুয়ে আলামত নষ্ট করে ফেলেন। পরদিন সকালে চিকিৎসার নাম করে সাদা চাদরে ঝিলিকের লাশ মুড়িয়ে গাড়িতে তুলে সাকিব হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা দেন। আর এই দৃশ্য ওই বাড়ির সিসি ক্যামেরার ফুটেজেও দেখা যায়। পরদিন ৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯টায় লাশ বহনকারী গাড়িটি হাতিরঝিলের আমবাগান এলাকায় ফুটপাথের ওপর উঠে গিয়ে দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। খবর পেয়ে হাতিরঝিল থানার পুলিশ ওই গাড়ি থেকে সাকিব ও ঝিলিককে বের করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক ঝিলিকের গলায় শ্বাসরোধের চিহ্ন ও দুই পায়ে বাঁধার চিহ্ন দেখে বলে তাকে হত্যা করা হয়েছে এবং কয়েক ঘণ্টা আগেই তার মৃত্যু হয়েছে। জানা গেছে, ২০১৮ সালের প্রথমদিকে সাকিব আলম মিশুর সঙ্গে ফেসবুকে পরিচয় হয় নিহত হাসনা হেনা ঝিলিকের। পরে তারা প্রেমের সম্পর্কে জড়ান। সাকিব বাবা-মায়ের কাছে পছন্দের বিষয়টি জানালে তারা ঝিলিকের পরিবার সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়ে বিয়েতে অমত দেন। কারণ ঝিলিক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান।

এক পর্যায়ে ছেলের জেদের কাছে হার মানেন সাকিবের বাবা-মা। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে পারিবারিকভাবেই বিয়ে হয় তাদের। বিয়ের পর সাকিবের বাড়িতেই ওঠেন ঝিলিক। কয়েক মাস তারা ভালোই ছিলেন। ২০২০ সালের প্রথমদিকে শুরু হয় অশান্তি। ঝিলিকের বাবা একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। আর সাকিব গুলশান-২ এর স্থায়ী বাসিন্দা। ঝিলিকের পরিবার মোহাম্মদপুরের তাজমহল এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর