শুক্রবার, ৭ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউয়ের মুখে ভারত নতুন ঝুঁকিতে নেপাল

প্রতিদিন ডেস্ক

করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া ভারতে তৃতীয় ঢেউ অবশ্যম্ভাবী বলে সতর্ক করেছেন দেশটির শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী। নরেন্দ্র মোদি সরকারের মুখ্য বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা কে বিজয়রাঘবন এই সতর্কবার্তা দিয়েছেন। এদিকে রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট জানিয়েছে, প্রতিবেশী নেপালে বর্তমানে প্রতি ১ লাখ মানুষের মধ্যে দৈনিক ২০ জনের করোনা ধরা পড়ছে। মাত্র দুই সপ্তাহ আগে ভারতেও একই পরিস্থিতি ছিল। সে কারণে নতুন ঝুঁকিতে পড়েছে নেপালও। সূত্র : রয়টার্স, এএফপি, সিএনএন।

প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, এক সংবাদ সম্মেলনে গত বুধবার মোদি সরকারের মুখ্য বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা কে বিজয়রাঘবন বলেন, করোনাভাইরাস উচ্চমাত্রায় ছড়িয়ে পড়ার কারণে ‘ফেইজ থ্রি’ বা তৃতীয় ঢেউ অবশ্যম্ভাবী। কোন সময়সীমার মধ্যে এটা ঘটবে তা স্পষ্ট নয়। তবে নতুন ঢেউয়ের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকা উচিত। এদিকে শনাক্ত রোগী সংখ্যায় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে থাকা ভারতে কভিড-১৯ গত বুধবারও এক দিনে রেকর্ড ৩ হাজার ৭৮০ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। সব মিলিয়ে কভিড-১৯ এ দেশটিতে এ পর্যন্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে ২ কোটি ৬ লাখ ৬৫ হাজার ১৪৮ জন; সরকারি হিসাবে ভাইরাসে মৃত্যু হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার ১৮৮ জনের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিবেদনে বলেছে, গত সপ্তাহে বিশ্বে করোনাভাইরাসে যত সংখ্যক নতুন সংক্রমণের তথ্য পাওয়া গেছে, তার অর্ধেকই ভারতে এবং চার ভাগের এক ভাগ মৃত্যুও সেখানেই হয়েছে। অনেক রাজ্যে চিকিৎসার অপেক্ষায় থাকা অসংখ্য কভিড আক্রান্তের মৃত্যু হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্সে, হাসপাতালের গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গায়। সৎকারের স্থানগুলো মরদেহের নিরবচ্ছিন্ন মিছিল সামাল দিতে হিমশিম অবস্থায়। গত ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে লাখ লাখ মানুষের অংশগ্রহণে ধর্মীয় উৎসব ও নির্বাচনী সমাবেশগুলোকে ‘সুপার স্প্রেডার’ বা ‘অতিমাত্রায় ছড়িয়ে দেওয়া’ আয়োজন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতে সংক্রমণ ও মৃত্যুর বাস্তব সংখ্যা সরকারি হিসাবের চাইতে পাঁচ থেকে দশ গুণ বেশি হতে পারে। মাত্র চার মাসে দেশে ১ কোটি মানুষ নতুন করে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে। অথচ ভাইরাসটি সেখানে শনাক্ত হওয়ার পর প্রথম ১ কোটি মানুষে সংক্রমিত হতে সময় লেগেছিল ১০ মাস।

ধরন নিয়ে সুখবর ও উদ্বেগ : ভারতে শনাক্ত করোনার নতুন ধরনের বিরুদ্ধে টিকা কাজ করছে বলে এনডিটিভি অনলাইনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। করোনার সংক্রমণে নাস্তানাবুদ ভারতের জন্য একে একটি সুখবর হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে এ-সংক্রান্ত একটি খারাপ খবরও আছে। আর তা হলো ভারতে শনাক্ত করোনার নতুন এ ধরনই একমাত্র সংস্করণ নয়। আরও নানা ধরন আছে। কারণ করোনাভাইরাস প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়। পরিবর্তিত হয়ে নিজের নতুন নতুন ধরন তৈরি করে। তাই ভারতে করোনার সম্ভাব্য আরও নতুন ধরন দ্রুত চিহ্নিত করার ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের সাবেক অধ্যাপক উইলিয়াম হ্যাসেলটাইন বলেন, করোনার ভারতীয় বি.১.১৬৭ ধরনের দ্বিতীয়, এমনকি তৃতীয় প্রজন্মের সংস্করণ এরই মধ্যে দেশটিতে ছড়িয়ে থাকতে পারে। এগুলো আরও বিপজ্জনক হতে পারে।

বড় বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে নেপাল : নেপালে রেড ক্রসের প্রধান ড. নেত্র প্রসাদ তিমসিনা এক বিবৃতিতে বলেছেন, ভারতে বর্তমানে যা হচ্ছে তা হলো নেপালের ভবিষ্যৎ। আমরা যদি এই করোনার স্রোত থামাতে না পারি, তাহলে আরও অনেক প্রাণ যাবে। নেপালে বর্তমানে প্রতি ১ লাখ মানুষের মধ্যে দৈনিক ২০ জনের করোনা ধরা পড়ছে। মাত্র দুই সপ্তাহ আগে ভারতেও একই পরিস্থিতি ছিল। গত সপ্তাহান্তে নেপালে করোনা টেস্টের ৪৪ শতাংশ ফলাফল পজিটিভ এসেছে। সেখানে দ্রুত গভীর সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। নেপালের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এমনিতেই ভঙ্গুর। সেখানে মানুষের তুলনায় চিকিৎসকের অনুপাত ভারতের চেয়ে কম, টিকাদানের হারেও প্রতিবেশীদের চেয়ে বিস্তর পিছিয়ে নেপালিরা। তাছাড়া সংক্রমণের উচ্চহারই প্রমাণ করে দিচ্ছে, পর্যাপ্ত পরীক্ষার অভাবে দেশটিতে বহু করোনা রোগী অশনাক্তই থেকে যাচ্ছেন। এমনকি করোনাভাইরাস পৌঁছে গেছে এভারেস্ট চূড়াতেও। নেপালের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ডা. সামির অধিকারী বলেছেন, পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। মাত্র এক মাস আগেও নেপালে দৈনিক ১০০ জন করে করোনা রোগী পাওয়া যাচ্ছিল। এখন তা ৮ হাজার ৬০০-তে এসে ঠেকেছে। অনেকেই এর জন্য করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত ভারতের সঙ্গে খোলামেলা সীমান্ত থাকাকে দায়ী করেছেন। ভারতে প্রবেশের জন্য নেপালিদের পাসপোর্ট বা আইডি কার্ড দেখানোর দরকার হয় না। এ কারণে সীমান্তের ওপারে ব্যবসা শুরু করেছেন অনেক নেপালি। অর্থাৎ, নেপাল-ভারত সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন প্রচুর মানুষ অবাধে চলাচল করে। তাছাড়া, সম্প্রতি ভারতের হাসপাতালগুলোতে শয্যা সংকট দেখা দেওয়ায় অনেকেই চিকিৎসা নিতে নেপালে ছুটে গেছেন। খবরে বলা হচ্ছে, গত ২৪ এপ্রিল নেপালে যেদিন ২ হাজার ৪০০-এর বেশি করোনা রোগী শনাক্ত হয়, সেদিনও প্রচুর মানুষজন ডেকে নতুন ধারাহারা টাওয়ার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী ওলি। ২০১৫ সালের এক ভূমিকম্পে ভেঙে পড়েছিল আগের টাওয়ারটি। এর পাঁচ দিন পর সংক্রমণের হার দ্বিগুণ বেড়ে যখন রোগীর সংখ্যা ৪ হাজার ৮০০-তে পৌঁছায়, তখন শুধু রাজধানী কাঠমান্ডুতে দুই সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা করে নেপাল সরকার। এর পরেরদিনই দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ঘোষণা দেয়, হাসপাতালে রোগী ধরছে না। ৩০ এপ্রিল এক বিবৃতিতে মন্ত্রণালয় জানায়, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় রোগীদের জন্য হাসপাতালে শয্যার ব্যবস্থা করা কঠিন হয়ে উঠেছে। গত সোমবার নেপালি প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সরকারের ‘সর্বাত্মক চেষ্টা’ সত্ত্বেও ভাইরাসটি দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। গত এপ্রিলে অসংখ্য নেপালি দেশে এবং দেশের বাইরে, অর্থাৎ ভারতে বিপুল জনসমাগমের মধ্যে ধর্মীয় উৎসব করেছেন। নেপালের হিন্দু পুণ্যার্থীরা কুম্ভমেলায় অংশ নিতে দলে দলে ভারত গেছেন। এদের মধ্যে ছিলেন নেপালের সাবেক রাজা জ্ঞানেন্দ্র শাহ এবং রানী কমল শাহ। ভারত থেকে ফেরার সময় তারা দুজনেই করোনা পজিটিভ শনাক্ত হন এবং বর্তমানে কাঠমান্ডুর একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। প্রায় একই সময়ে হাজার হাজার নেপালি তাদের রাজধানীতে পাহান চার্হে উৎসবের জন্য সমবেত হন। আরেক দল যান ভক্তপুরে ঐতিহ্যবাহী বিস্কেট যাত্রায় অংশ নিতে। অবশ্য প্রশাসন তাদের এ উৎসবে যেতে নিষেধ করেছিল। তবে ‘উৎসব আমাদের প্রাণের চেয়ে প্রিয়’ ব্যানার লিখে ঠিকই তাতে শামিল হন স্থানীয়রা। সীমান্তবর্তী শহর নেপালগঞ্জের একটি করোনা ইউনিটের জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক ডা. পরশ শ্রেষ্ঠ জানান, তাদের হাসপাতালে রোগীর চাপ এত বেশি যে, তারা মাঝারি উপসর্গযুক্ত রোগীদের বাড়িতেই আইসোলেশনে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন। জানা গেছে, এ অবস্থায় গতকাল থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সব আন্তর্জাতিক ফ্লাইট। চলাচলে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে দেশটির ৪৬টি জেলায়।

সর্বশেষ খবর