গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মক্কেলের পক্ষে একটি মামলা দায়ের করেছিলেন ঢাকা জজ আদালতের আইনজীবী জাহাঙ্গীর আলম। মামলাটিতে জুডিশিয়াল তদন্ত দিয়েছিল আদালত। তদন্ত প্রতিবেদন জমা হওয়ার পর এ বিষয়টি আদেশের জন্য ধার্য রয়েছে। কিন্তু করোনা সংক্রমণ রোধে আদালতের নিয়মিত কার্যক্রম বন্ধ থাকায় অন্য মামলার সঙ্গে এ মামলাটিও আটকে যায়। আইনজীবী জাহাঙ্গীর বলেন, দীর্ঘদিনেও আদেশ না হওয়ায় মক্কেল আমাকে বিশ্বাসই করতে চাচ্ছেন না। এখন তো যোগাযোগই বন্ধ করে দিয়েছেন।
ঢাকার আদালতের আইনজীবী ইমতিয়াজ আহমেদের অবস্থাও একই। তিনি বলেন, ২০১৩ সালে দাখিল হওয়া অর্পিত সম্পত্তির একটি মামলা ২০১৫ সালে আমার কাছে আসে। মামলাটি শুনানি শেষে রায়ের জন্য ধার্য হয়। করোনার কারণে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ হলে কয়েক দফা রায়ের ধার্য তারিখ বদলায়। মাঝে মাঝে কিছু সময়ের জন্য আদালতের কার্যক্রম স্বাভাবিক হলেও সেই সময়ে রায় না হওয়ায় মক্কেলের কাছ থেকে খারাপ আচরণও পেয়েছি। অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম ও ইমতিয়াজ আহমেদের মতোই অবস্থা সারা দেশের আইনজীবীদের। করোনার কারণে দীর্ঘদিন আদালতের নিয়মিত কার্যক্রম বন্ধ থাকায় মক্কেলের সঙ্গে তাদের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। কখনো কখনো আইনজীবীর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস হারাচ্ছেন মক্কেল। আইনজীবীরা জানান, দীর্ঘদিন আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম না থাকায় একদিকে আইনজীবীদের আয় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে, অন্যদিকে প্রত্যাশিত সময়ে মামলার কার্যক্রম শেষ না হওয়ায় পুরনো মক্কেলরাও যোগাযোগ বন্ধ করে দিচ্ছেন। করোনাকালীন সংকটে পেশা ছেড়ে যাচ্ছেন অনেক নবীন আইনজীবী। গত বছর ২৬ মার্চ
সাধারণ ছুটি শুরু হওয়ার পর দীর্ঘ সময় ধরে প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে বিচারাঙ্গন। পরে আদালত কর্তৃক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ভার্চুয়াল বিচার ব্যবস্থা চালু করায় কিছুটা সংকট কাটে। এরপর অধ্যাদেশটি আইনে রূপান্তর করে সরকার। সীমিত পরিসরে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে চলে আদালতের কার্যক্রম। করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করা হলেও সংক্রমণ বৃদ্ধি পেলেই আবার বন্ধ হয়ে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে করোনা সংক্রমণের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকার ঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে বন্ধ রয়েছে বিচার বিভাগের নিয়মিত কার্যক্রমও। এক প্রকার থমকেই আছে বিচারাঙ্গন। হাই কোর্টে মাত্র তিনটি ভার্চুয়াল বেঞ্চ এবং সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় নিম্ন আদালতে সীমিত পরিসরে শুধু ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের কার্যক্রম চলছে। আইনজ্ঞরা বলেন, করোনাকালে দেশের বিচার বিভাগের বড় ক্ষতি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে হলেও বিচারপ্রার্থীর সাংবিধানিক ও আইনি অধিকার রক্ষায় জামিন, আমলযোগ্য অপরাধের মামলার ফাইলিং ও দেওয়ানি মামলায় নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত শুনানি চালু রাখতে হবে। একই সঙ্গে রায়ের জন্য থাকা মামলাগুলোর রায়ও ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে হলেও দেওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। অন্যদিকে উচ্চ আদালতে ভার্চুয়াল বেঞ্চ বৃদ্ধি করে নিয়মিত বিচারকাজ পরিচালনা করার দাবিও জানিয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ও সাধারণ আইনজীবী ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক ড. মোমতাজ উদ্দিন আহমেদ মেহেদী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর দীর্ঘদিন আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকায় আইনজীবীদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। পেটে খাবার নাই। একই সঙ্গে কারও কাছে হাত পাতারও সুযোগ নেই। তিনি বলেন, শিল্প কারখানা খুলে দেওয়া হচ্ছে। পরিবহন চালু করে দেওয়া হচ্ছে। তাহলে আদালতের কার্যক্রম কেন বন্ধ থাকবে। তিনি আরও বলেন, এমন অনেক মানুষ মাসের পর মাস জেলে আটকে আছে, যিনি আদালত খোলা থাকলে এক মাসেই জামিনে মুক্তি পেতে পারতেন।