বুধবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

পত্রিকার পাতায় ছিল নিখোঁজের খোঁজ

মির্জা মেহেদী তমাল

পত্রিকার পাতায় ছিল নিখোঁজের খোঁজ

লাশটি কার- এ শিরোনামে একটি জাতীয় দৈনিকের ভিতরের পাতার নিচের দিকে ছোট্ট একটি খবর ছাপা হয়। খবরে বলা হয়, সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গে এক তরুণীর লাশ পড়ে আছে। ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও কোনো দাবিদার পাওয়া যায়নি। পরদিন একই পত্রিকায় আবারও সেই সংবাদ। এবার মৃতদেহের চেহারার ছবি দিয়ে খবরটি প্রকাশ হয়। এ খবরে বলা হয়েছে, লাশের কোনো দাবিদার না পাওয়ায় লাশটি বেওয়ারিশ হিসেবে দাফনের প্রস্তুতি চলছে। এবারও কোনো দাবিদার নেই। পত্রিকায় এ নিয়ে পরের দিন আর কোনো খবর নেই। তার পরের দিন পত্রিকাটিতে সেই তরুণীকে নিয়ে আবারও সংবাদ প্রকাশিত হলো ফলোআপ হিসেবে। সেদিনও আগের ছবিটি সংবাদের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। তৃতীয়বারের সংবাদটিতে লেখা হয়, সেই তরুণীর লাশটি বেওয়ারিশ হিসেবে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তারা লাশটি দাফন করে। এমন নিউজ প্রকাশের পর কয়েক ব্যক্তি আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের কার্যালয়ে হাজির। তাদের হাতে সেদিনের পত্রিকা। তারা নিউজটি দেখিয়ে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের কর্মকর্তাদের কাছে আরও কিছু জানতে চান। কারণ তারা তাদের মেয়েকে খুঁজে পাচ্ছেন না। লাশ দাফনের আগে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের পক্ষ থেকে বেওয়ারিশ লাশের ছবি তুলে রাখা হয়। কর্মকর্তারা সেই মৃতদেহের ছবি দেখান। স্বজনরা ছবি দেখেই আঁতকে ওঠেন। ছবিটা হাতে নিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। তারা নিশ্চিত। বেওয়ারিশ লাশটি আর কেউ নয়! লাশটি তাদের প্রিয় সন্তানের। তিনি হলেন তিন্নি। বাংলাদেশের জনপ্রিয় মডেল তারকা সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নি। পত্রিকায় প্রকাশিত একটি ছোট্ট সংবাদই জনপ্রিয় মডেল তিন্নির লাশ শনাক্ত করে দেয়। ফাঁস হয় তিন্নির নিখোঁজ হওয়া থেকে শুরু করে তার খুনের নেপথ্য কাহিনি। সেদিন পত্রিকায় না হলে হয়তো তিন্নি খুনের ঘটনাটি ভিন্ন মোড় নিত। অথবা নিখোঁজের তালিকায় থেকে যেতেন তিন্নি। স্বজনরা জানতেও পারতেন না, কোথা থেকে কী হয়ে গেছে তাদের সন্তানের জীবনে। তিন-চার দিন ধরে বেওয়ারিশ হিসেবে মর্গে পড়েছিল তরুণীর লাশ। যখনই তার পরিচয় উদঘাটন হলো, তখন থেকেই দেশজুড়ে তোলপাড়। আর এ ঘটনার সঙ্গে এক সময়ের ছাত্রনেতা সাবেক এমপি গোলাম ফারুক অভির নামটি জড়িয়ে পড়ায় ঘটনাটি আলোচনার শীর্ষে থাকে। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে অফিস আদালত- সর্বত্র আলোচনার অন্যতম বিষয় ছিল তিন্নি খুনের ঘটনাটি। পত্র-পত্রিকাগুলো তিন্নি খুনের ঘটনাটি গুরুত্বসহকারে প্রকাশ করে। পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে মিডিয়া জগতের নানা অজানা কাহিনি। তিন্নির কর্মকান্ডের নানা গোপন তথ্য বেরিয়ে আসে। এমনকি ওই সময় তিন্নি ও সাবেক এমপি অভির পরকীয়া সম্পর্কের চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস হয়। যার পরিণতি হয় একটি খুনের মধ্য দিয়ে। ১৯ বছর আগে ঘটে যাওয়া এ ঘটনা এখনো মাঝে-মধ্যে আলোচনায় চলে আসে। বিশেষ করে মডেল তিন্নি হত্যা মামলার খড়গ মাথায় নিয়ে লাপাত্তা বনে যাওয়া অভিকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলগুলোতে কৌত‚হল বাড়ছেই। তবে আলোচিত এ খুনের পর ১৯ বছর পেরিয়ে গেলেও বিচার এখনো শেষ হয়নি। বিচার নিয়ে তিন্নির পরিবার হতাশ। ১১ নভেম্বর, ২০০২ সাল। সকাল ৮টা। বুড়িগঙ্গা নদীর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর নিচে পিলারের উঁচু জায়গায় অজ্ঞাত এক তরুণীর লাশ পড়ে আছে। সেখানে মানুষের ভিড় বাড়ছে। খবর পেয়ে আসে পুলিশ। লাশটি উদ্ধার করে। ময়নাতদন্তের জন্য সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গে লাশ পাঠানো হয়। সুরতহাল রিপোর্ট তৈরির সময় পুলিশ লাশের শরীরের বিভিন্ন অংশে থেঁতলানো জখম দেখতে পায়। মাথার খুলিতে ভোঁতা অস্ত্রের আঘাত ছিল। আঘাতের চিহ্ন দেখে পুলিশ নিশ্চিত হয়, এটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। কেরানীগঞ্জ থানার এএসআই শফিউদ্দিন ওইদিন দুপুরে একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় কাউকে আসামি করা হয়নি। মামলায় বলা হয়, আগের দিন রাতের আঁধারে অজ্ঞাতনামা তরুণীকে হত্যা করে লাশ গোপন করার জন্য বুড়িগঙ্গা সেতুর নিচে ফেলে দেওয়া হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে দাবিদার না থাকায় মর্গেই পড়ে থাকে লাশটি। ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত কোনো দাবিদার না আসায় লাশটি আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পত্রিকায় ছবি দেখে তিন্নির চাচা সৈয়দ রেজাউল করিম লাশটি শনাক্ত করেন। পরে ২১ নভেম্বর লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে ফের ময়নাতদন্ত করা হয়। হত্যা মামলার তদন্তের একপর্যায়ে কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ নিহত তিন্নির সাবেক স্বামী শাফাকাত হোসেন পিয়াল, এবায়দুল্লাহ ওরফে স্বপন গাজী, গাজী শরিফউল্লাহ তপন, শফিকুল ইসলাম জুয়েল ও সোমনাথ সাহা বাপ্পীকে গ্রেফতার করে। তাদের স্বীকারোক্তিতে উঠে আসে হত্যাকান্ডে অভির সম্পৃক্ততা। হত্যাকান্ডটি ব্যাপক আলোচিত হওয়ায় মামলাটি পুনঃতদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডিকে। দীর্ঘদিন তদন্ত শেষে সিআইডি ২০০৮ সালে একমাত্র আসামি হিসেবে অভির নামে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়। সিআইডি মামলাটির তদন্তের পর অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয় তিন্নির সাবেক স্বামী পিয়ালসহ পাঁচজনকে। তিন্নিকে কে হত্যা করতে পারে, তদন্তের ভার পেয়ে সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তার সামনে সেটিই উদঘাটন ছিল মূল কাজ। তিন্নির বাসার কাজের মেয়ে বিনা, গাড়ির চালক ও অন্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ নিশ্চিত হয়, এক সময়কার প্রভাবশালী ছাত্রনেতা, সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভি তিন্নিকে হত্যা করে লাশ গোপন করার চেষ্টা করেন। মডেল তিন্নির সঙ্গে অভির পরিচয় হওয়ার পরই তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক তৈরি হয়। তারা দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ান। তিন্নি ছিলেন বিবাহিত। অভির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে তিন্নির সঙ্গে স্বামী শাফাকাত হোসেন পিয়ালের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ২০০২ সালের ৬ নভেম্বর অভি নিজে তিন্নি ও তার স্বামী পিয়ালের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটান। এমনকি তিন্নির দেড় বছরের শিশুকন্যাসহ পিয়ালকে বাসা থেকে বের করে দেন অভি। অভি ওই বাসায়ই অবস্থান নেন। এ সময় তিন্নি বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকেন অভিকে। কিন্তু অভি তাকে বিয়ে করবেন বলে আশ্বাস দিতে থাকেন। কিন্তু কবে করবেন, তা স্পষ্টভাবে কখনো তিন্নিকে বলেননি। পিয়ালের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি ও তিন্নির সঙ্গে অভির সম্পর্কের বিষয়টি জানাজানি হতে থাকে। এ সময় তিন্নির সঙ্গে অভির সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। বিয়ে নিয়ে তাদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া-বিবাদ হতে থাকে। অভির কথা মিডিয়াকে জানিয়ে দেবে বলে তিন্নি হুমকি দেয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে অভি। এরপরই হত্যার পরিকল্পনা। পুলিশের তদন্ত থেকে জানা যায়, পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী অভি ২০০২ সালের ১০ নভেম্বর সন্ধ্যার পর তিন্নিকে মাথায় আঘাত করে হত্যা করেন। লাশ গুম করার জন্য গাড়িতে করে নিয়ে বুড়িগঙ্গা সেতু থেকে ফেলে দেন। তখন লাশটি পিলারের উঁচু জায়গায় পড়ে থাকে। এদিকে ১০ নভেম্বর থেকে তিন্নি নিখোঁজ হলে তার আত্মীয়-স্বজনরা খোঁজখবর নিতে থাকেন। পত্রিকায় তিন্নির ছবি প্রকাশের পরই অভি গা ঢাকা দেন। তার আগ পর্যন্ত অভি ছিলেন প্রকাশ্যেই। যুক্তিতর্ক শেষ হলেও দুই বছর ধরে বারবার রায়ের তারিখ ঘোষণা সত্ত্বেও দেওয়া হয়নি মডেল তিন্নি হত্যা মামলার রায়। প্রায় ৯ বছর বিচার কার্যক্রম চলার পর ২০১৯ সালের জুলাই মাসে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান রাখে আদালত। ঢাকার সপ্তম অতিরিক্ত জেলা জজ আদালতে এ মামলার বিচার শুরু হয় ২০১০ সালের ১৪ জুলাই। এদিন আসামি সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়। বিচারকাজ চলাকালীন প্রসিকিউশন অধিকাংশ সাক্ষীকেই আদালতে উপস্থিত করে। মামলার যুক্তিতর্কে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (এপিপি) অ্যাডভোকেট ভবতোষ দাশ আদালতকে বলেন, মডেল সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নি হত্যাকান্ডে সাবেক সংসদ সদস্য অভিকে হত্যাকারী হিসেবে দোষী সার্ব্যস্ত করে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করা হোক। অনুপস্থিত আসামি গোলাম ফারুক অভির পক্ষে স্টেট ডিফেন্স অ্যাডভোকেট শাহ ইলিয়াস রতন তার যুক্তিতর্কে বলেন, অভি তিন্নিকে হত্যা করেননি। তিন্নি আত্মহত্যা করেছেন। সন্দেহের বশে অভিকে এ মামলায় জড়ানো হয়েছে। এক সময়ের আলোচিত-সমালোচিত ছাত্রনেতা গোলাম ফারুক অভি এখন কোথায়? দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় আগে দেশত্যাগ করা সাবেক এ এমপিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কোনো খবরেই। দেখাও মিলছে না কোথাও। মামলার অভিযোগপত্র থেকে জানা যায়, অভি এখন কানাডায় রয়েছেন। ২০০৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তার বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলার ঘটনায় রেড অ্যালার্ট নোটিস জারি করা হয়। ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাকে দেশে আনার চেষ্টাও করা হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর