শুক্রবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

অতিমাত্রার শোকেই খুনি ধরা

মির্জা মেহেদী তমাল

অতিমাত্রার শোকেই খুনি ধরা

বাবার বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে নিখোঁজ হন চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা রিজিয়া আক্তার রূপা। পরে তার লাশ পাওয়া গেলেও রূপার স্বামী হায়দার আলীর অভিযোগ, খুনের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন কাজল নামে এক যুবক। কাজল তার স্ত্রীর প্রেমিক। কিন্তু পুলিশ তদন্ত করতে যেয়ে কাজলের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায় না। বরং পুলিশ যে তথ্য পায় তাতে  করে তদন্ত নেয় ভিন্ন মোড়। বান্দরবান ধলিয়া মুসলিমপাড়ার নুরুল ইসলামের মেয়ে রূপা খুনের রহস্য উদঘাটনে পুলিশের তদন্তের এ পর্যন্তই তুলে ধরা হয়েছিল গতকালের গোয়েন্দা কাহিনিতে। আজ তুলে ধরা হচ্ছে ঘটনার শেষ অংশ। গত মাসের ৭ তারিখ বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেও রূপাকে জীবন্ত পাওয়া যায়নি। তার লাশ পাওয়া যায় বান্দরবান রাঙামাটি সড়কের গলাচিপা মুসলিম পাড়ার ঝোপঝাড়ের মধ্যে। রাতেই গলাকাটা নারীর লাশ দেখে লোকজন পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ লাশটি উদ্ধার করে। লাশটি রূপার। তার পরিবার শনাক্ত করে লাশটি। নৃশংস খুনের শিকার রূপার লাশ উদ্ধারের পর স্বামী হায়দার আলী ভেঙে পড়েন। লাশ ধরে তিনি আহাজারি করেন। তার কান্নায় স্থানীয় লোকজন চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। হায়দার আলী বলছিলেন, রূপা তুমি চলে গেলে আমায় একা রেখে। আমি বাঁচব কীভাবে? স্ত্রী খুনের পর কখনো চিৎকার করে, কখনো নীরবে কাদেন হায়দার আলী। আর বলতে থাকেন, কাজল তুই এত বড় ক্ষাতি কেন করলি? আমার স্ত্রীকে কেন খুন করলি। চোখভরা জল নিয়ে স্ত্রীর দাফন-কাফন শেষ করেন হায়দার আলী। একই এলাকার কাজল নামের এক যুবক তার স্ত্রী খুনের ঘটনায় জড়িত বলে অভিযোগ করেন হায়দার। স্বামী হায়দার আলী বান্দরবান থানায় স্ত্রী হত্যায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় তিনি আসামি করেন রাঙামাটির বাঙ্গালহালিয়া ইউনিয়নের ডাকবাংলা বৌদ্ধ বিহার পাড়ার রকির প্রকাশ (রক্যার) ছেলে মোহাম্মদ কাজল হোসেনকে। হায়দার আলীর অভিযোগ, বিয়ের আগে কাজলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। বিয়ে করার কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে তার স্ত্রী রূপাকে খুন করেছে কাজল। পুলিশ তদন্ত শুরু করে। অভিযুক্ত কাজলকে গ্রেফতারে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়েও তাকে গ্রেফতার করতে পারে না।  এদিকে স্ত্রীর খুনি গ্রেফতার না হওয়ায় পুলিশের ওপর ক্ষুব্ধ হয় হায়দার আলী। থানায় গিয়ে পুলিশের কাছে যেয়ে বসে থাকে। ধরনা দিতে থাকে কাজলকে গ্রেফতারের জন্য। পুলিশ রূপা হত্যা মামলাটি নিজেদের মতো করে তদন্ত চালাতে থাকে। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাচাই করে তদন্ত কাজ এগিয়ে নিতে থাকে। তদন্তকারী কর্মকর্তা বান্দরবান সদর থানার এস আই গোবিন্দ এই হত্যাকান্ডের রহস্য বের করতে বদ্ধপরিকর। তার চোখে রূপার স্বামীর শোক একটু ভিন্ন ধরনের লাগতে থাকে। তিনি খুব তীক্ষèভাবে খেয়াল করে দেখেন, হায়দার আলীর শোকের মধ্যে কোথাও ভিন্ন ধরনের ছাপ রয়েছে। এ বিষয়টি ভাবিয়ে তোলে তদন্ত কর্মকর্তাকে। পুলিশ খবর পায়, ঘটনাস্থল পাহাড়ের নিচে সড়কের সমানে একটি সিএনজিচালিত অটো দেখা গেছে সেই রাতে। পুলিশকে ভাবিয়ে তোলে। পুলিশ খোঁজখবর নিতে শুরু করে সিএনজির। হয়তো খুনের ভিন্ন কোনো তথ্যও পাওয়া যেতে পারে। পুলিশ পেয়ে যায় সিএনজির নম্বর। নম্বরের সূত্র ধরে পুলিশ পৌঁছে যায় সিএনজির মালিকের বাসায়। পুলিশ মালিকের কাছে চালকের তথ্য চায়। মালিক তখন জানায়, ৭ আগস্ট এই সিএনজিরচালক ছিল মান্নান। যিনি এখন আর সিএনজি চালান না। তবে তার ঠিকানা আছে। পুলিশ ছুটে চলে মান্নানের বাসায়। মান্নানকে পায় না পুলিশ। পেয়ে যায় মান্নানের মাকে। মান্নানের মা পুলিশকে জানায়, সিএনজিটি সেদিন মান্নানের কাছ থেকে হায়দার আলী নিয়ে গিয়েছিল। আর হায়দারের মোটরসাইকেল রেখে যায় মান্নানের কাছে। কী একটা কাজের কথা বলে হায়দার আলী সিএনজিটি নিয়ে গেছে। এটি কাউকে বলতে বারণ করেছে। তদন্ত কর্মকর্তা নিজেই বিড় বিড় করে বলতে থাকেন, তদন্ত ঠিক দিকেই এগোচ্ছে। এরপর পুলিশ পেয়ে যায় মান্নানকে। মান্নান জানায়, হায়দার আলীর বাসা তাদের একই এলাকায়। অনেক পুরনো বন্ধুত্ব। হায়দার আলী বিদেশ ছিল। তার আগে এখানে সিএনজি চালাত। মান্নান বলে, সেদিন হায়দার আলী এসে জানায়, আমার মোটরসাইকেলটি তুই চালাতে থাক। আমার একটা কাজ আছে। তোর সিএনজি আমার লাগবে। এ কথা শুনে আমি তাকে সিএনজির চাবিটা দেই। হায়দার সিএনজি নিয়ে চলে যায়। পরে রাতে দিয়ে যায়। কি করেছে সেটা আমি জানি না। পুলিশ তখন অনেকটাই নিশ্চিত, খুনে কাজল নয়, খুনে জড়িত স্বয়ং স্বামী হায়দার আলী। পুলিশ এবার হায়দারকে গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত নেয়। ঘটনার ২৮ দিনের মাথায় পুলিশ হায়দারের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করে। থানায় নিয়ে চলে জেরা। কিন্তু সে সব অস্বীকার করতে থাকে। এরপর তার বন্ধু সিএনজিচালক মান্নানকে মুখোমুখি করা হয়। তখন হায়দার আলী আর জবান বন্ধ রাখতে পারে না। বলে দেয় সব মুখস্থ নামতার মতো। হায়দার আলী জানায়, কাজলের সঙ্গে তার স্ত্রীর আগে সম্পর্ক ছিল। এই সম্পর্ক বিয়ের পরও টিকে ছিল। সে নিজেই দেখেছে তাদের বলতে। শুধু মাত্র কথা বলতে দেখেই এমন খুনের সিদ্ধান্ত কেন নিল, এমন প্রশ্নের জবাবের কোনো উত্তর দিতে পারেনি হায়দার। যোগাযোগ করা হলে পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা এস আই গোবিন্দ বলেন, হায়দার আলী তার স্ত্রীকে সন্দেহ করতেন। সন্দেহের বশে খুনের সিদ্ধান্ত নেয়। সে স্বীকার করে বলেছে, ঘটনাটি সে একাই ঘটিয়েছে। রূপাকে হত্যার পর ফেলে দেয় পাহাড়ের পাশে ঝোপের মধ্যে। রূপার গলায় ছুরি চালালে রক্ত তার শার্টেও লাগে। পরে তার নিজের কাপড় খুলে তাতে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। লাশ উদ্ধারের পরই সে বলে বেড়াতে থাকে, কাজল খুন করেছে তার স্ত্রীকে। পুলিশ কর্মকতা গোবিন্দ আরও জানান, ঘটনার পর রূপার স্বামী হায়দার আলীর অতিমাত্রায় শোক ভাবিয়ে তোলে। একপর্যায়ে তার ওপর নজরদারি শুরু করি। সোর্স নিয়োগ করি। এরপরই তদন্তে বেরিয়ে আসে ভিন্ন ধরনের তথ্য। হায়দার আলী আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে।

সর্বশেষ খবর