শুক্রবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

২ ট্রিলিয়ন ডলারের হালাল পণ্যের বাজার হাতছাড়া হচ্ছে

মান নির্ণয়ে নেই স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষ, সহায়তা করতে চায় মালয়েশিয়া

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

করোনা মহামারীর কারণে ২০১৯ সালে বিশ্ব বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও হালাল বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ শতাংশের ওপরে। মুসলিম দেশগুলোর বাইরে এখন ইউরোপ ও আমেরিকার মতো পশ্চিমা দেশগুলোতে হালাল পণ্যের বাজার বাড়ছে। সারা বিশ্বে হালাল পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হলেও সম্ভাবনাময় এই বাণিজ্য খাতে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। মুসলিম প্রধান দেশ হওয়ার পরও হালাল বাণিজ্যে সামগ্রিক স্কোরে শীর্ষ ১৫ দেশের মধ্যে নেই বাংলাদেশ। শুধু হালাল ফ্যাশনে শীর্ষ দশ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সপ্তম স্থানে থাকলেও হালাল খাদ্য, ইসলামিক ফাইন্যান্স, হালাল ট্যুরিজম, হালাল ফার্মা ও কসমেটিকসে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ দশে নেই।

স্টেট অব দ্য গ্লোবাল ইসলামিক ইকোনমি রিপোর্ট ২০২০-২১ এর তথ্য অনুযায়ী- ২০১৯ সালে সারা বিশ্বে হালাল পণ্য ও সেবা খাতে খরচ করে মোট ২ ট্রিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। ২০২৪ সালে হালাল বাণিজ্যের পরিমাণ ২ দমমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত হতে পারে বলে ওই রিপোর্টে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কেবল নীতিগত সিদ্ধান্তের অভাবে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে সারা বিশ্বে সম্ভাবনাময় এই হালাল বাণিজ্যের বাজার।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওআইসিভুক্ত মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে ইউরোপ, আমেরিকা, চীন, সিঙ্গাপুর, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার মতো শিল্পোন্নত দেশগুলোতেও প্রসার লাভ করছে হালাল পণ্যের বাজার। এমনকি মুসলিম দেশ না হওয়া সত্ত্বেও সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কার মতো অমুসলিম দেশগুলো সঠিক নীতি গ্রহণ করে হালাল পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে গেছে। বৈশ্বিক ইসলামিক অর্থনীতি সূচক (জিআইইআই) এর সর্বশেষ (২০২০) রিপোর্ট অনুযায়ী হালাল পণ্যের বাজারে শীর্ষে রয়েছে মালয়েশিয়া। শীর্ষ ১৫টি রাষ্ট্রের মধ্যে ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর বাইরে সিঙ্গাপুর ও শ্রীলঙ্কা থাকলেও সেখানে বাংলাদেশের ঠাঁই হয়নি। সঠিক সময়ে নীতিগত কৌশল গ্রহণ করতে না পারা, হালাল পণ্যের সার্টিফিকেশন দিতে একটি পৃথক কর্তৃপক্ষ গঠন করতে না পারার কারণে বাংলাদেশ হালাল পণ্যের বাজার ধরতে ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সূত্র জানায়, হালাল পণ্যে সার্টিফিকেট দিতে পৃথক কর্তৃপক্ষ করার জন্য শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত কয়েক বছর ধরে বেশ কয়েকটি বৈঠক করেছে। সেসব বৈঠকে হালাল খাদ্যের সার্টিফিকেশনের জন্য একটি কর্তৃপক্ষ গঠনের বিষয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সহায়তার সুপারিশও রয়েছে। তারপরও গত পাঁচ বছরে একটি পৃথক কর্তৃপক্ষ গড়ে ওঠেনি দেশে। রপ্তানিকারকদের দাবির মুখে সম্প্রতি দেশের পণ্যের মান নির্ণয় প্রতিষ্ঠান বিএসটিআই হালাল খাদ্য ও কসমেটিকসের সার্টিফিকেট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এ ধরনের সার্টিফিকেট বহির্বিশ্বে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে সে বিষয়ে সংশয় রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর  জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শুধু হালাল পণ্য নয়, সাধারণ পণ্যের ক্ষেত্রেও বিএসটিআইর সার্টিফিকেটের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির প্রযুক্তি এবং দক্ষতাগত দুর্বলতাও রয়েছে। ফলে বিশেষায়িত পণ্যের মান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এই দুর্বলতাগুলো দূর করতে বিএসটিআইর উচিত হবে আন্তর্জাতিক এজেন্সিগুলোর সহায়তায় নিজেদের মান নির্ণয় কার্যক্রমকে আরও উন্নীত করা, যাতে আমাদের রপ্তানিকারকরা বিনা প্রশ্নে যে কোনো দেশে হালাল পণ্য রপ্তানি করতে পারে। তাহলেই শুধু বিশ্বব্যাপী হালাল বাণিজ্যের যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে সেটি ধরতে পারবে বাংলাদেশ।

সহায়তা করতে চায় মালয়েশিয়া : বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় হালাল পণ্য রপ্তানিকারক দেশ মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি হালাল ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (এইচডিসি) রয়েছে। সংস্থাটির প্রধান নির্বাহীর সঙ্গে গত মে মাসে বৈঠক করেছে কুয়ালালামপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনের কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউসের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে হালাল ইকোসিস্টেম প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে মালয়েশিয়ার এইচডিসি। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক করা যেতে পারে। চিঠিতে বলা হয়, মালয়েশিয়ায় হালাল সার্টিফিকেট প্রদানের কাজটি করছে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে পরিচালিত ডিপার্টমেন্ট অব ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট মালয়েশিয়া (জাকিম)। দেশটির অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশেও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে একটি হালাল ডেভেলপমেন্ট সেন্টার গঠন করা যেতে পারে বলে সুপারিশ করা হয় ওই চিঠিতে। মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার গোলাম সারওয়ার চিঠিতে উল্লেখ করেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর জিএসপি সুবিধা উঠে গেলে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় কমে যাওয়ার যে আশঙ্কা করা হচ্ছে, এ উত্তম বিকল্প হতে পারে হালাল পণ্য রপ্তানির সম্প্রসারণ। এক্ষেত্রে প্রথম প্রয়োজন দেশের অব্যন্তরে একটি শক্তিশালী হালাল ইকোসিস্টেম প্রতিষ্ঠা করা। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)-এর ভাইস চেয়ারম্যান ও সিইও এ এইচ এম আহসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা হালাল পণ্যের মার্কেটিংয়ে কাজ করছি। তবে বিশ্ববাজার ধরতে হলে এর পাশাপাশি সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর বিশেষায়িত এ পণ্য ও সেবার মানের সার্টিফিকেশনের ব্যাপারেও গুরুত্ব দেওয়া উচিত। ইপিবির প্রধান নির্বাহী বলেন, এত দিন হালাল পণ্যের সার্টিফিকেট আসত ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে। বিএসটিআই সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে তারা পণ্য ও কসমেটিকসের সার্টিফিকেট দেবে। যেহেতু বিএসটিআইর মান নির্ণয় সংক্রান্ত প্রযুক্তি ও সক্ষমতা আছে, তাদের উচিত হবে সেই সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তা নিয়ে হালাল পণ্যের সার্টিফিকেশন দেওয়ার স্বীকৃতি আদায় করা।

সর্বশেষ খবর