শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ৪ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

পণ্য বিক্রি না করেই কোটি টাকা আয়!

ই-কমার্সের অন্তরালে এমএলএম

শামীম আহমেদ

রাতারাতি টাকা বানানোর বিস্ময়কর কৌশল যেন ‘এমএলএম ই-কমার্স’। আজগুবি এই ই-কমার্স (অনলাইনে ব্যবসা-বাণিজ্য) ব্যবসায় পণ্য নয়, বিক্রি হচ্ছে আইডি! সাধারণ মানুষকে লোভের ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। দেওয়া হচ্ছে ১ লাখ টাকার আইডি খুলে বছরে তিন-ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত মুনাফার প্রস্তাব! এমএলএম (মাল্টি লেভেল মার্কেটিং) পদ্ধতিতে অন্যদের কাছে আইডি বিক্রি করলে মিলবে রেফার বোনাস, জেনারেশন বোনাসসহ নানা আর্থিক সুবিধা! নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্ধারিত সংখ্যক আইডি বিক্রি করতে পারলে রয়েছে কক্সবাজার ট্যুর, মোটরসাইকেল, গাড়ি, সপরিবারে বিদেশ সফরসহ কোটি টাকা পুরস্কার! সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ই-কমার্সের অন্তরালে এমন লোভের জাল বিছিয়ে গ্রাহক প্রতারণা চলছেই। এরই মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান টাকা নিয়ে গা ঢাকা দিলেও টনক নড়ছে না কারও। এদিকে সরকার ই-কমার্সের আড়ালে এমএলএম ব্যবসা নিষিদ্ধ করেছে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে সেই প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাতিলসহ জেল-জরিমানার বিধান যুক্ত করে ই-কমার্স পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ আইন করা হচ্ছে। তবে ই-কমার্সের নামে এমএলএম ব্যবসা দেদার চলছে। দেশের ব্যাংকগুলো যেখানে ১ লাখ টাকা জমা রাখলে বছরে মুনাফা দিচ্ছে সাড়ে ছয় থেকে সাড়ে সাত হাজার টাকা, সেখানে ১ লাখ টাকার আইডি কিনে বছরে তিন-ছয় লাখ টাকা আয়ের লোভনীয় প্রস্তাবে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে মানুষ। ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট খালি করে বিনিয়োগ করছে এই প্রতিষ্ঠানগুলোয়। এক পর্যায়ে লাখো মানুষের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে লাপাত্তা হয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। মাত্র ১১০০ টাকা দিয়ে আইডি খুললে দৈনিক ২০ টাকা করে মাসে ৬০০ টাকা আয়ের লোভনীয় প্রস্তাব নিয়ে গত জানুয়ারিতে গাজীপুরে চালু হয় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ‘সহজ লাইফ’। মুনাফা ছাড়াও প্রথমেই  দেওয়া হয় ৮৫০ টাকার পণ্য। শর্ত ছিল প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে প্রতিদিন বিজ্ঞাপন দেখতে হবে। ঘরে বসে এমন আয়ের খবরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে মানুষ। প্রথমে দুই-তিন মাস টাকা দেওয়ার পর শুরু করে গড়িমসি। গত ১২ সেপ্টেম্বর প্রায় ২৫ হাজার গ্রাহকের ২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা হাতিয়ে উধাও হয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটি। পরে কাশিমপুর থানায় লিখিত অভিযোগ দেন গ্রাহকরা। একইভাবে ২২ লাখ মানুষের কাছ থেকে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় এমএলএম ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান এসপিসি ওয়ার্ল্ড। পরে গ্রেফতার হন প্রতিষ্ঠানটির এমডি আলামিন। ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে প্রায় ১১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলার পর ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার বিষয়টি বড় আকারে সামনে আসলেও থামছে না প্রতারণা।

১ হাজার টাকা বিনিয়োগে দৈনিক ১০ টাকা মুনাফার প্রস্তাব দিয়ে গত এপ্রিলে রাজধানীতে যাত্রা শুরু করেছে বাইওটেক ই-কমার্স লিমিটেড। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান হলেও এমএলএম পদ্ধতিতে বিক্রি করছে আইডি। প্রথমে প্রতি আইডির দাম ১ হাজার টাকা রাখা হলেও বর্তমানে ১ হাজার ৩৫০ টাকা। অনলাইনে এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির উল্লেখযোগ্য কোনো পণ্য বিক্রির নজির না থাকলেও সাত মাসে সাড়ে সাত লাখের মতো আইডি বিক্রি করে বাজার থেকে সংগ্রহ করেছে প্রায় ৭৮ কোটি টাকা। এর একটি অংশ প্রতি আইডির পেছনে দৈনিক ১০ টাকা করে মুনাফা হিসেবে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অন্যদের কাছে আইডি বিক্রি করলে রেফার বোনাস ও জেনারেশন বোনাস পাওয়ার পাশাপাশি নির্দিষ্ট সংখ্যক আইডি বিক্রি করলে রয়েছে কক্সবাজার ভ্রমণ, গাড়ি, নগদ আড়াই কোটি টাকা পর্যন্ত উপহার পাওয়ার লোভনীয় প্রস্তাব। এর মধ্যে দ্রুততম সময়ে কোটি টাকার আইডি বিক্রি করে গাড়ি অর্জনকারী প্রথম দুজনকে গত ৭ সেপ্টেম্বর জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে গাড়ি হস্তান্তর করে প্রতিষ্ঠানটি। গত জুলাইতে বায়োটেকের মূল প্রতিষ্ঠান বিশ্ব গ্রুপে ১০০ জন ফাউন্ডার নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। শর্ত দেওয়া হয়, আগস্টের মধ্যে প্রত্যেককে ৩ হাজার ৬০০ আইডি বিক্রি করে ফোর স্টার অর্জন করতে হবে। এমন নানামুখী লোভনীয় প্রস্তাবে অনেকেই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খালি করে বিনিয়োগ করেছে প্রতিষ্ঠানটিতে। সরেজমিন মিরপুর ১০ নম্বরের ৩ নম্বর সড়কে প্রতিষ্ঠানটির অফিসে গ্রাহক হিসেবে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন কক্ষে নতুন গ্রাহকদের ব্যবসার পরিকল্পনা বোঝানো হচ্ছে। সাড়ে সাত লাখ গ্রাহককে প্রতিদিন ১০ টাকা করে দৈনিক ৭৫ লাখ টাকা মুনাফা (বিভিন্ন বোনাস ও উপহার ছাড়া) কোথা থেকে দেওয়া হয়- এমন প্রশ্নে প্রতিষ্ঠানটির স্টার গ্রাহকরা বলেন, বিশ্ব গ্রুপের বিভিন্ন ব্যবসার লাভ থেকে মুনাফা দেওয়া হচ্ছে। মিরপুর সেনপাড়ায় বিশ্ব গ্রুপের একটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট সরঞ্জাম বিক্রির দোকান, বাড্ডায় বিশ্ব টেলিকম অ্যান্ড টেকনোলজি নামে একটি মোবাইল ফোন বিক্রির দোকান, কল্যাণপুরে একটি বিজনেস ক্যাফে ছাড়াও বাইওটেক ও বিশ্ববাজার নামের দুটি ওয়েবসাইটে পণ্য বিক্রি করা হয়। তবে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানগুলো চালু হয়েছে গত দুই মাসে। এ ছাড়া বাইওটেক ও বিশ্ববাজার নামের ওয়েবসাইট দুটিতে রয়েছে হাতেগোনা কিছু পণ্য, যার বেশিরভাগই কমিশন নির্ভর অ্যাফেলিয়েট মার্কেটিং করা বিদেশি প্রতিষ্ঠানের পণ্য। এসব নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুল কবির শিমুলকে ফোন করলে তিনি বলেন, নানামুখী প্রতারণার কারণে ইকমার্স ও এমএলএম নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। ট্রেড লাইসেন্স, জয়েন্ট স্টক থেকে কোম্পানি নিবন্ধন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধন সবই আমার আছে। এ ছাড়া সামাজিক অবস্থানের কারণে আমার পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কোনটা ই-কমার্স আর কোনটা এমএলএম সেটা ভাগ করাই কঠিন। এমএলএম নিষিদ্ধও করা হয়নি, নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলা হয়েছে। সরকার দুই মাস সময় দিয়েছে। এর মধ্যে যে নীতিমালা আসবে, সেটা মেনেই ব্যবসা করব। মূলত, বাইওটেক একটি আইডিয়া, যার মাধ্যমে আমি আইডি বিক্রি করে আগে গ্রাহক শ্রেণি তৈরি করছি, এরপর তাদের কাছেই পণ্য বিক্রি করব। আগামী দুই মাসের মধ্যেই আমার সম্পূর্ণ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়ে যাবে। এ ছাড়া প্রতিদিন যে ১০ টাকা দেওয়া হয়, সেটা ৬০০ টাকা না হলে কেউ তুলতে পারে না। আবার সেই টাকার একটা অংশ দিয়ে তারা আমার প্রতিষ্ঠান থেকেই পণ্য কিনবে, যেখানে আমি ভালো লাভ করব। এটা মূলত মাইক্রোকন্ট্রিবিউট আইডিয়া। সরকার যদি আইন করে এটা নিষিদ্ধ করে, তাহলে বন্ধ করে দেব।

সর্বশেষ খবর