ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর সুমি শহরে আটকে পড়েছিলেন ৯ বাংলাদেশি। তারা এক ধরনের অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিলেন। সময় কাটিয়েছেন কখনো বাসায়, কখনো বাংকারে। গত মঙ্গলবার এ ৯ বাংলাদেশিকে রেডক্রসের সহায়তায় উদ্ধার করে ভারতীয়রা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ জন্য টেলিফোনে ধন্যবাদ জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে।
গণমাধ্যমের কাছে এই ৯ বাংলাদেশি রোমহর্ষক অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন। তাদের মধ্যে সুমি শহর থেকে উদ্ধার হওয়া ৯ বাংলাদেশির একজন ব্যবসায়ী রুবায়াত হাবিব জানিয়েছেন, ‘কয়েকটি দিন কীভাবে কেটেছে- তা কারও পক্ষে বলা সম্ভব নয়। বেঁচে থাকাটা অলৌকিক ঘটনা মনে হচ্ছে। ইউক্রেনের সুমি থেকে আমরা যখন বের হচ্ছিলাম, তখন অন্তত ৫০টি রাশিয়ান ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান শহরটিতে ঢুকছিল।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যখনই সাইরেন শুনতে পেতাম তখনই বাংকারে ঢুকে যেতাম। সাইরেনের শব্দে চারদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ত। জীবনে কোনো দিন এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে-স্বপ্নেও ভাবিনি। যা কল্পনা করা যায় না, তেমন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে বেঁচে ফিরলাম। সাজানো একটা দেশ চোখের সামনে তছনছ হয়ে গেল। প্রতিদিন প্রায় ৪ থেকে ৬ ঘণ্টা বাংকারে থাকতে হয়েছে। রাশিয়ার বোমার আঘাতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ক্ষতি হওয়ায় মাঝে দুই দিন বিদ্যুৎ ছিল না, পানি ছিল না। মাইনাস ৫ ডিগ্রির নিচে এখানকার তাপমাত্রা। হিটিং সিস্টেম ছাড়া ওই দুই দিন যে কী কষ্ট হয়েছে তা বোঝাতে পারব না।’
১২ বছর ধরে ইউক্রেনে বসবাসরত আইটি কনসালট্যান্ট রুবায়াত হাবিব কীভাবে সুমি শহর ছাড়লেন সেই বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘সকাল ৯টার দিকে আমরা ইউক্রেনের বাসা-বাংকার থেকে বের হই। ৭০০ ভারতীয় শিক্ষার্থী ও আমাদের ৯ জন বাংলাদেশির জন্য ৫০টি বাস অপেক্ষা করছিল। ৫০টি বাসে আমরা রওনা হই। প্রথমে আমাদের বাসে করে নিয়ে যাওয়া হয় পোলতাবা নামের একটি স্থানে। পোলতাবায় পৌঁছানোর জন্য সময় লাগার কথা তিন ঘণ্টা। কিন্তু আমাদের পোলতাবায় পৌঁছতে সময় লাগে ১২ ঘণ্টা।’
চার গুণ বেশি সময় কেন লাগল সে বিষয়ে রুবায়াত বলেন, ‘৫০টি বাস একসঙ্গে যাওয়ার জন্য কিছুটা ধীরে চালাতে হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য যে গ্রিন চ্যানেল করে দিয়েছে সেটি ঘোরা পথ। আমরা সকাল ৯টায় রওনা দিয়ে রাত ৯টায় পোলতাবা পৌঁছাই। ৫০টি বাসের প্রতিটিতে ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যাত্রী ছিলাম। সারাক্ষণ ছিল গুলি-বোমা-মৃত্যুর আতঙ্ক।’ তিনি জানান, তার স্ত্রী এবং দুই সন্তানের সবার বসার জন্য আসন ছিল না বাসে। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ ১২ ঘণ্টা যাত্রার পুরোটা সময় আমি ও আমার স্ত্রী দাঁড়িয়ে থেকেছি। দুই সন্তানকে সিটে বসিয়ে পথ শেষ হওয়ার অপেক্ষায় কেটেছে ১২ ঘণ্টা। বেঁচে থাকার আনন্দের কাছে এই কষ্ট যেন কিছুই না। বেঁচে থাকব, একটা সময় তো এমন আশাই করতে পারছিলাম না।’
পোলতাবা থেকে ট্রেন ছাড়ার পর কিছুটা স্বস্তি ফিরতে থাকে উল্লেখ করে রুবায়াত বলেন, ‘আমরা তখন ইউক্রেনের সীমান্ত শহর লিভিভের কাছাকাছি চলে এসেছি। এই অঞ্চলের পরিস্থিতি শান্ত। কিছুক্ষণের মধ্যে লিভিভে পৌঁছাব। এখন ভয়, মৃত্যু আতঙ্ক অনেকটাই কেটে গেছে। লিভিভে ট্রেন থেকে নেমে বাসে আবার ৬ ঘণ্টার যাত্রা শেষে পৌঁছাব ইউক্রেন-পোল্যান্ড সীমান্তে। রেডক্রস এবং ভারতীয়রা সব ব্যবস্থা করবে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের বাস-ট্রেনে রেডক্রসের চিহ্ন দেওয়া আছে। যুদ্ধবিরতিতে রাশিয়া ও ইউক্রেনীয় বাহিনীর সম্মতিতেই আমাদের গাড়িগুলো চলেছে। যে কারণে কোনো বাহিনীর বাধার মুখেই আমরা পড়িনি, কেউই আমাদের আটকায়নি।’ স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে সুমি শহরে বসবাস করছিলেন রুবায়াত। সেখানেই তার ব্যবসা। বাসা ছেড়ে আসার দিনের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘আমরা বাসা ছেড়ে শেল্টারে আসার কিছু সময় পরেই ওই এলাকায় বোম্বিং হয়েছে। আমার বাসা থেকে ১৫০ মিটার দূরে রাশিয়া বোমা বর্ষণ করেছে। বোমার আঘাতে দুই শিশুসহ ২২ জন মারা গেছেন। এই খবর যখন পেলাম তখন বেঁচে যাওয়ায় আনন্দিত হব, নাকি এতগুলো মানুষের মৃত্যুতে দুঃখিত হব বুঝতে পারছিলাম না। একেবারে হতবিহ্বল হয়ে পড়ি। আমাদের বাসার এত কাছে বোমা ফেলা হয়েছে, চলে আসার সুযোগ না পেলে ২২ জনের মধ্যে হয়তো আমরাও থাকতাম! কত জীবন কত সংসার ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল কয়েক দিনের যুদ্ধে। ইউক্রেনের মানুষের ভাগ্যে সামনে যে আরও কী অপেক্ষা করছে!’
 
                         
                                     
                                                             
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        