রবিবার, ৩১ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা
বর্বরতা

প্রতিবন্ধী যুবককে হাত-পা বেঁধে হাতুড়ি দিয়ে নির্যাতন

ফরিদপুর প্রতিনিধি

ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে গরুচোর সন্দেহে গণপিটুনিতে গুরুতর আহত হয়েছেন মানসিক প্রতিবন্ধী এক যুবক। তার নাম মো. জসিম মোল্লা (২৭)। তিনি উপজেলার গুণবহা ইউনিয়নের নয়ানীপাড়া গ্রামের মৃত শুকুর মোল্লার ছেলে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় জসিম বোয়ালমারী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। এ ঘটনায় এলাকায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। ঘটনায় জড়িতদের বিচার চেয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। পুলিশ বলছে, বিষয়টি খতিয়ে দেখে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

স্থানীয় লোকজন জানান, বুধবার ভোরে উপজেলার দাদপুর ইউনিয়নের কমলেশ্বরদী গ্রামের মাহুতপাড়ায় নৃশংসতার শিকার হন মানসিক প্রতিবন্ধী জসিম। গরুচোর সন্দেহে জসিমকে স্থানীয় কয়েকজন যুবক ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করলে নিজের নাম ছাড়া কিছুই বলতে পারেননি। এতে চোর সন্দেহ করে রশি দিয়ে হাত-পা বেঁধে হাতুড়ি, লোহার রড ও লাঠি দিয়ে পিটিয়ে তার সারা শরীর থেঁতলে দেওয়া হয়েছে। সাঁড়াশি দিয়ে উপড়ে ফেলা হয়েছে পায়ের একাধিক আঙুলের চাড়া। সিগারেটের আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে শরীরের বিভিন্ন স্থান। এ ছাড়া কথা বলতে না পাড়া মানসিক প্রতিবন্ধী জসিমের নাক ও মুখের ভিতর খেজুরের কাঁটা দিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করা হয়েছে। চরম বর্বরতার শিকার জসিম সংজ্ঞা হারিয়ে ফেললে তাকে গরুচোর সাজিয়ে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। পরে পুলিশ জসিমকে নিয়ে বোয়ালমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে তিনি চিকিৎসাধীন। সরেজমিন হাসপাতালে গিয়ে জসিমের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে তাকে শুধু চোখের পানি ফেলে হাউমাউ করে কাঁদতে দেখা যায়। জসিমের শরীরের বিভিন্ন অংশ লাঠি দিয়ে পিটিয়ে থেঁতলে দেওয়ায় শরীরজুড়ে কালচে দাগ রয়েছে। অনেক অংশ কেটে রক্তাক্ত জখম হয়েছে।

দাদপুর ইউনিয়নের মাহুতপাড়া গ্রামের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, বৃহস্পতিবার রাতে খগেন মাহুতের দুটি গরু চুরি হয়। চুরির সময় গোয়ালঘরে থাকা ছাগলের চিৎকারে বাড়ির লোকজনের ঘুম ভেঙে যায়। পরে তারা দেখতে পান দুটি গরু নেই। এ সময় লোকজন এলাকায় গরুচোর ঢুকেছে বলে মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা দিলে মুহূর্তের মধ্যেই কয়েক হাজার লোক বেরিয়ে পড়েন। এ সময় একটি পাটখেতের সামনে জসিমকে দেখতে পান তারা। জসিমের সামনে একটি গরু থাকায় লোকজন তাকে চোর সন্দেহ করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। তিনি কোনো কথা না বললে উত্তেজিত লোকজন তাকে মারধর করতে থাকে। পরে জয়নগর পুলিশ ফাঁড়িতে খবর দিলে পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।

স্থানীয় ইউপি মেম্বার জাফর বলেন, ‘জসিম যে প্রতিবন্ধী তা লোকজন জানত না। গরুসহ তাকে পেয়ে চোর ভেবে মারধর করা হয়। আমরা কয়েকজন মারধরের হাত থেকে তাকে রক্ষা করেছি। উত্তেজিত লোকজন বেশি মারধর করতে থাকলে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়।’ তিনি বলেন, হয়তো চোরের দলটি প্রতিবন্ধী জসিমকে চুরি করা গরু নেওয়ার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে থাকতে পারে।

জসিমের চাচাতো ভাই নিজাম মোল্লা জানান, জসিম মানসিক প্রতিবন্ধী। এক সপ্তাহ আগে তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেননি। তাকে বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেও না পাওয়ায় এলাকায় মাইকিং করা হয়। পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবিসহ হারিয়ে যাওয়ার খবর প্রচার করার পাশাপাশি বিভিন্ন্ হাট-বাজারে লিফলেটও বিতরণ করা হয়। জসিমকে কোথাও না পেয়ে বোয়ালমারী থানায় হারিয়ে যাওয়া মর্মে অভিযোগ দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘শুক্রবার এক প্রতিবেশী জসিমকে আহত অবস্থায় দেখতে পেয়ে আমাদের খবর দিলে আমরা তার অবস্থা দেখে হতভম্ব হয়ে যাই। তাকে নির্মমভাবে পেটানো হয়েছে। শরীরের এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে আঘাতের চিহ্ন নেই। আমার প্রতিবন্ধী ভাইকে যারা চোর সাজিয়ে, মিথ্যা অপবাদ দিয়ে মেরে রক্তাক্ত করেছে তাদের বিচার চাই।’ তিনি বলেন, থানায় অভিযোগ দিলেও তা গ্রহণ করা হয়নি। রবিবার (আজ) আদালতে মামলা করা হবে। বোয়ালমারী হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক মো. খালেদুর রহমান বলেন, ‘জসিমের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তিনি নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। তাকে সুস্থ করে তুলতে আমরা কাজ করছি।’ বোয়ালমারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আবদুল ওহাব বলেন, ‘খবর পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে একটি গরুসহ জসিমকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। জসিমের পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি।’

 

 

সর্বশেষ খবর