শনিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা
গ্যাসের চুলায় লিকেজ

দুর্ঘটনা নয়, যেন মৃত্যুফাঁদ

২০২১ সালে গ্যাস সরবরাহ লাইন থেকে সৃষ্ট দুর্ঘটনা ঘটে ৩ হাজার ৯২২টি; মৃত্যু ৮৮ জনের

জিন্নাতুন নূর

গ্যাস লিকেজ থেকে সৃষ্ট দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যুর তালিকা কেবল দীর্ঘই হচ্ছে। অবস্থা এমনই যে, বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন, এটি নিছক দুর্ঘটনা নাকি এক ধরনের মৃত্যুফাঁদ। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ গ্যাসের চুলা থেকে সৃষ্ট দুর্ঘটনা রোধে প্রচার-প্রচারণা চালালেও এই দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানী ও আশপাশে যে অগ্নিদুর্ঘটনাগুলো ঘটছে তার প্রায় ৩০ শতাংশই গ্যাস সৃষ্ট আগুনের কারণে ঘটছে। আর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের তথ্যমতে, ২০২১ সালে গ্যাস সরবরাহ লাইন থেকে সৃষ্ট দুর্ঘটনা ঘটে মোট ৩ হাজার ৯২২টি। এতে ৮৮ জনের মৃত্যু হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানী ঢাকায় যে গ্যাসলাইন বসানো আছে তা ১৫ থেকে ২০ বছরের পুরনো। এগুলো থেকে গ্যাস লিক হওয়ার ঝুঁকি বেশি। নিরাপত্তার স্বার্থে মাসে অন্তত একবার হলেও গ্যাসের গ্রাহকদের ঘরে গ্যাস লিক হচ্ছে কি না তা তদারকি করা প্রয়োজন বলে তারা পরামর্শ দিয়েছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, সারা দেশ থেকে মাসে অন্তত ৫০০ আগুনে পোড়া রোগী এই হাসপাতালে ভর্তি হন। এর এক-পঞ্চমাংশেরই মৃত্যু হয় এবং তাদের ৪০ শতাংশই গ্যাসের আগুনে দগ্ধ হন।

সর্বশেষ গত ৩০ আগস্ট কেরানীগঞ্জে গ্যাসের চুলার বিস্ফোরণ থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ একই পরিবারের ছয়জনের মৃত্যু হয়। এর আগে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় বায়তুল সালাত জামে মসজিদে গ্যাসের পাইপলাইন দুর্ঘটনায় ৫৪ জন মুসল্লি দগ্ধ হন। এ ঘটনায় ৩৪ জনের মৃত্যু হয়। ২০২০ সালের অক্টোবরে রাজধানীর আরমানিয়ান স্ট্রিটের একটি রাস্তায় গ্যাসলাইনের লিকেজ থেকে সৃষ্ট বিস্ফোরণে ৯ জন পথচারী আহত হন। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার রয়েল রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড পার্টি সেন্টারে গ্যাস লিকেজ থেকে সৃষ্ট বিস্ফোণে তিনজন আহত হন। গত বছরের ৭ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে ধুপতারা ইউনিয়নের কুমারপাড়া গ্রামে গ্যাসলাইনের লিকেজ থেকে সৃষ্ট দুর্ঘটনায় কাপড় বিক্রেতা সোলায়মান দগ্ধ হয়ে মারা যান। এ ঘটনায় তার স্ত্রী ও দুই সন্তান দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। একই বছরের নভেম্বরে রাজধানীর মুগদায় একটি বাসায় গ্যাস লিকেজ থেকে আগুন লেগে এক পরিবারের চারজন দগ্ধ হন। এতে দুজনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া গ্যাস লিকেজ থেকেই গত বছর রাজধানীর মগবাজারের তিনতলা ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয় বলে সংশ্লিষ্ট সংস্থার লোকজনের ধারণা। এ ঘটনায় ১১ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন শতাধিক মানুষ। সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজধানী ঢাকায় এখন যে গ্যাস পাইপলাইন নেটওয়ার্ক আছে তা ‘টিকিং টাইম বোম’ এর মতো। যে কোনো মুহূর্তে এই বোমা বিস্ফোরিত হয়ে ঘটতে পারে বড় দুর্ঘটনা। কারণ, ঢাকায় যে গ্যাসলাইন বসানো আছে তা ১৫ থেকে ২০ বছর পুরনো। এগুলো থেকে গ্যাস লিক হওয়ার ঝুঁকিও বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা আরও বলেন, ঢাকায় যে লাইন দিয়ে ৫০ জন গ্রাহকের লাইনে গ্যাস আসার কথা সে লাইন দিয়ে ৫০০ জন গ্রাহককে গ্যাস দেওয়া হয়। ফলে সেই লাইনে চাপ বেড়ে যাচ্ছে। আবার পাইপলাইনগুলো দুর্বল হওয়ায় এর প্রেসার নেওয়ার ক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। এই পাইপলাইনগুলোতে জং ধরছে এবং যে লাইনগুলো খোঁড়াখুঁড়ির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা থেকেও গ্যাস লিক হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বলেন, রাজধানীর গ্যাস পাইপলাইনগুলোর কত জায়গায় যে লিকেজ আছে তা কেউ জানে না। আমাদের এখানে একটি দুর্ঘটনা ঘটলে সবাই ঝুঁকিপূর্ণ লাইন মেরামতে গুরুত্ব দেয়। কিন্তু এতে কোনো লাভ নেই। শহরে অসংখ্য অবৈধ লাইন আছে যেখানে লিকেজ হচ্ছে। এ জন্য গ্যাস দুর্ঘটনা রোধে সরকার ও দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাকে একটি মাস্টারপ্ল্যান নিতে হবে। এর আওতায় পুরো পাইপলাইনকে সার্ভে করে অবৈধ সংযোগের মতো বিপজ্জনক পয়েন্ট চিহ্নিত করে পুরনো লাইনগুলোও একই সঙ্গে বদলাতে হবে। এটি করা না গেলে কেউই বিপদমুক্ত হতে পারবে না। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেন, গ্যাসের গ্রাহকদের নিজেদেরই গ্যাস সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। গ্যাস লিকেজের মতো ঘটনায় গ্রাহকদের গা-ছাড়া ভাবের কারণে অনেক সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটে যায়। মাসে অন্তত একবার হলেও সবাইকে ঘরে গ্যাস লিক হচ্ছে কি না তা নিরাপত্তার স্বার্থে তদারকি করা প্রয়োজন। বিভিন্ন সংস্থাকেও এ ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।

 

সর্বশেষ খবর