শুক্রবার, ২১ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

ছিনতাইকারী আতঙ্ক নগরে

যানজটের ভিড়ের মধ্যে ছুরি হাতে বাসে হামলা

আলী আজম

ছিনতাইকারী আতঙ্ক নগরে

বাসের জানালা দিয়ে ছিনতাইকারীর হাতে দেখা যায় ছুরি

ঘটনা-১ : মঙ্গলবার সন্ধ্যা। ঢাকার আসাদ গেট ফুটওভার ব্রিজের নিচে ভিড়ের মধ্যে ছুরিহাতে একদল ছিনতাইকারী বাসে হামলা চালায়। এতে যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনাটি একজন যাত্রী ভিডিও করেন। ওই যাত্রী বলেন, বাসের এক যাত্রীর ফোন জানালা দিয়ে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা হলে তিনি ছিনতাইকারী বলে চিৎকার দেন। যাত্রীরা তখন একসঙ্গে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করেন। রাস্তার উল্টো দিকে থাকা পুলিশের একটি ভ্যান থেকে বাঁশিও বাজানো হয়। এতে সেই ছিনতাইকারী সরে যায়।

কিন্তু এর পরপরই ছুরিহাতে তিন-চার জন ছিনতাইকারী বাসের দিকে তেড়ে গেলে যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। যাত্রীরা চিৎকার করে বাসের হেলপার ও সুপারভাইজারকে দরজা আটকে দিতে বলেন। বাসের এক যাত্রী বলেন, ‘কত বড় চাকু হাতে, দেখছেন! দিনদুপুরে বাসে ডাকাতি।’ আরেকজন বলেন, ‘পুলিশ দেখল, একটা বাঁশি ফুঁ দিল আর চইলা গেল। আর ওরা তো চাকু নিয়া ঘুরতাছে।’

ঘটনা-২ : রবিবার সন্ধ্যা। রাজধানীর আসাদ গেট এলাকায় ছিনতাইয়ের শিকার হন একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের একজন নারী সাংবাদিক। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় রাইড শেয়ারের মোটরসাইকেলে অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে আসাদ গেট পেট্রোলপাম্পের সামনে যানজটে দাঁড়ানো অবস্থায় তার ফোনে কল আসে। তিনি ফোন কানে নিলে ১৭-১৮ বছরের এক তরুণ ফোনটি ছিনিয়ে নিয়ে দৌড় দেয়। এ সময় ওই নারী সাংবাদিক মোটরসাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে আঘাত পান।

ঘটনা-৩ : ১১ আগস্ট রাত। উত্তরায় এটিএম বুথ থেকে টাকা তোলার সময় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন টাইলস ব্যবসায়ী শরিফ উল্লাহ।

ঘটনা-৪ : ২৯ জুলাই। পল্লবীর কালশীতে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন রিকশাচালক আবদুল লতিফ হাওলাদার। ঘটনা-৫ : ১৮ জুলাই রাত। হাজারীবাগের চেয়ারম্যানগলিতে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন অজ্ঞাত এক যুবক। ঘটনা-৬ : ১৭ জুলাই। ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে খিলগাঁও তালতলায় নিহত হন সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক মামুন হাওলাদার। শুধু এ ঘটনাগুলোই নয়, এমন চিত্র এখন রাজধানীজুড়ে। ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ছিনতাইকারী চক্র। রাজধানীর প্রতিটি স্থানে এ মুহূর্তে বড় আতঙ্কের নাম ছিনতাই। বেপরোয়া ছিনতাইকারীদের ভয়ে পথচারীদের তটস্থ হয়ে চলাফেরা করতে হয়। শুধু সন্ধ্যা বা রাত নয়, দিনদুপুরেও এখন ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সশস্ত্র ছিনতাইকারী চক্র ছিনতাই কাজে ব্যবহার করছে মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেল। এদের টার্গেট ভ্যানেটি ব্যাগ, হাতব্যাগ, স্বর্ণালঙ্কার ও মোবাইল ফোনসেট। পুলিশ ও অন্য সূত্রগুলো বলছেন, রাজধানীতে রয়েছে শতাধিক ছিনতাই স্পট। প্রায় ৬০০ ছিনতাইকারী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পুরো রাজধানী। প্রতিদিন গড়ে ২৫টি ছিনতাই ঘটছে। এদের কেউ অজ্ঞান পার্টি, কেউ মলম পার্টি, কেউবা আবার সালাম পার্টির সদস্য। শুধু রাতের আঁধারে নয়, দিনের আলোয় প্রকাশ্যে সর্বস্ব লুটে নিয়ে মুহূর্তে সটকে পড়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে ছিনতাইকারী। সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা আতঙ্কিত করে তুলেছে নগরবাসীকে। ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজনও। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ছিনতাইয়ের অনেক ঘটনাই থানা-পুলিশে যায় না। চুরি ও ছিনতাইয়ের শিকার বেশির ভাগ মানুষই হয়রানি ও ঝামেলার আশঙ্কায় মামলা করেন না। এতে চুরি ও ছিনতাইয়ের মামলা হয় কম। মামলা হলেও চুরি ও ছিনতাই করা টাকা উদ্ধার করতে পারে না পুলিশ। আবার কেউ কেউ মামলা করতে গেলেও থানা তা নেয় জিডি হিসেবে। এতে প্রকৃত ঘটনা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। ছিনতাইয়ের শিকার ব্যক্তিরা বলছেন, পুলিশ জানে কোন কোন এলাকা ছিনতাইপ্রবণ। এর পরও ব্যবস্থা নিতে তাদের অনেক অনীহা। আর ঘটনা জানালেও প্রভাবশালী না হলে প্রতিকার পাওয়া যায় না। বরং নানা ভোগান্তি সইতে হয়। তবে পুলিশ বলছে, ছিনতাইয়ের ঘটনা জানালে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এ ছাড়া জাতীয় জরুরি সেবা ট্রিপল নাইনে (৯৯৯) কল করেও এ সেবা পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ‘ছিনতাইয়ের চেয়ে চুরি বাড়ছে। ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হচ্ছে, আমরা তদন্ত করে ছিনতাইকারীদের ধরছি। ছিনতাই সে হারে বাড়েনি। ছিনতাইকারীদের ধরতে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। যারা ছিনতাই করে ধরা পড়েন তাদের আমরা গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখছি।’ র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, রাজধানীতে বিভিন্ন ছিনতাই স্পট চিহ্নিত করা হয়েছে। গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারীদের ধরতে নিয়মিত অভিযান চালানো হয়েছে। চিহ্নিত স্পটে মাঝে মাঝে ঝটিকা অভিযান চালানো হচ্ছে। ছিনতাইকারীদের প্রতিরোধে র‌্যাব সর্বদা তৎপর রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ-বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, ছিনতাইয়ের ঘটনা নতুন কিছু নয়। তবে নতুন নতুন পদ্ধতিতে ছিনতাইয়ের ঘটনা নগরবাসীকে আতঙ্কিত করে তুলছে। কেউ যখন ছিনতাইয়ের কবলে পড়েন তখন অন্য কেউ প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসেন না, এটা একটা বড় সমস্যা। অর্থনৈতিক সংকটে থাকা বা মাদকসেবীরা ছিনতাইকে পেশা বা কাজ হিসেবে বেছে নিচ্ছে। ছিনতাইকে বড় কোনো ধরনের অপরাধ হিসেবে এখনো গণ্য করা হয় না। ফলে যারা গ্রেফতার হয় তারা আদালত থেকে দ্রুত জামিনে বের হয়ে ফের একই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। রাজধানীতে ছিনতাইয়ের যেসব স্পট রয়েছে তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবহিত আছে। কিন্তু সেসব স্পটেই অহরহ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। মূলত ছিনতাইকারীদের পেছনে পৃষ্ঠপোষক রয়েছে। নইলে তারা এভাবে বেপরোয়া হতে পারে না। ছিনতাইকারীসহ এসব পৃষ্ঠপোষককে আইনের আওতায় আনতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর