রবিবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

বছর শেষে দাঁড়ানোর চেষ্টায় বিএনপি

শফিকুল ইসলাম সোহাগ

বছর শেষে দাঁড়ানোর চেষ্টায় বিএনপি

দীর্ঘ ১৬ বছর ক্ষমতায় না থাকা বিএনপি আগামী নির্বাচন সামনে রেখে চলতি বছরের শুরু থেকেই নানা দাবিতে সক্রিয় ছিল। দলটির আলোচিত পদক্ষেপ ছিল প্রায় তিন মাস ধরে সমাবেশের মধ্য দিয়ে বড় ধরনের জমায়েত করে সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে বার্তা দেওয়া। রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতে ২৭ দফা রূপরেখা প্রকাশ করা। ছয় সংসদ সদস্যের পদত্যাগ করা। দলটি ১০ সাংগঠনিক বিভাগে ১০ গণসমাবেশ করা। সবচেয়ে আলোচিত ছিল রাজধানীতে ১০ ডিসেম্বর সমাবেশ করে সরকারের পতন ঘটানোর হুমকি দেওয়ার বিষয়। এ ছাড়া অন্যান্য আলোচিত বিষয়ের মধ্যে ছিল ২৫ বছর ধরে সঙ্গে চলা শরিকদের সঙ্গ ত্যাগ করা। যুগপৎ আন্দোলনের লক্ষ্যে ৩৬ দলের সঙ্গে সংলাপ করা। চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশ পাঠানো ও মুক্তির দাবি। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ নেতা-কর্মীদের আটকের ঘটনা। এ রকম নানান ঘটনার মধ্য দিয়ে বছরজুড়েই আলোচনায় ছিল বিএনপি।

সংসদ সদস্যদের পদত্যাগ : গত সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে অংশ নিয়ে নির্বাচনে ছয়জন বিজয়ী হন। পরে সংরক্ষিত নারী আসনের একটি পায় দলটি। নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তুলে শুরুতে বিএনপি জানিয়েছিল, তারা সংসদে যাবে না। পরে সিদ্ধান্ত বদলে শপথ নেন দলটির সংসদ সদস্যরা। শপথ নেওয়ার পর থেকেই পদত্যাগ করার কথা বললেও তারা তা করেননি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির গণসমাবেশ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন বিএনপির সংসদ সদস্যরা। এরপর ওইসব আসনে ১ ফেব্রুয়ারি উপনির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।

১০ বিভাগে সমাবেশ : সারা দেশের নেতা-কর্মীদের চাঙা করতে ১২ অক্টোবর চট্টগ্রাম থেকে বিভাগীয় সমাবেশ শুরু করে দলটি। পর্যায়ক্রমে ২২ অক্টোবর খুলনা, ২৯ অক্টোবর রংপুর, ৫ নভেম্বর বরিশাল, ১২ নভেম্বর ফরিদপুর, ১৯ নভেম্বর সিলেট, ২৬ নভেম্বর কুমিল্লায় ও ৩ ডিসেম্বর রাজশাহীতে গণসমাবেশ করে। শেষে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

আলোচিত ১০ ডিসেম্বর : ঢাকার বাইরের সমাবেশ শেষে ঢাকায় সমাবেশের প্রায় দেড় মাস আগে দলটির নেতা আমান উল্লাহ আমানের এক বক্তব্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। তিনি বলেন, ১০ ডিসেম্বর থেকে দেশ চলবে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নির্দেশে। ফলে ১০ ডিসেম্বর যতই ঘনিয়ে আসতে থাকে রাজনৈতিক অঙ্গনে ততই বাড়তে থাকে উত্তেজনা। বিশেষ করে কোথায় সমাবেশ হবে এ নিয়ে বিএনপি ও পুলিশ প্রশাসনের মধ্যে চলতে থাকে দফায় দফায় আলোচনা। বিএনপি নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে চাইলেও সরকারের পক্ষ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা যে কোনো মাঠে করার কথা বলা হয়। তবে নয়াপল্টনেই সমাবেশ করতে অনড় থাকে বিএনপি। এ নিয়ে বিতর্ক ও আলোচনার মধ্যেই ৭ ডিসেম্বর বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে একজনের মৃত্যু এবং অনেকে আহত হন। সরকারি দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা থেকে শুরু করে মন্ত্রী-এমপিরা ১০ ডিসেম্বরে সমাবেশ নিয়ে বক্তব্য দিতে থাকেন। সাধারণ মানুষের মনেও প্রশ্ন ওঠে- কী হতে যাচ্ছে ১০ ডিসেম্বর। বিএনপি কি ঢাকায় সমাবেশ করতে পারবে, ক্ষমতাসীন দলের ভূমিকা কী থাকবে, রাজধানীতে দুই দলের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে কি না? এ অবস্থায় বিএনপি কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাসহ বহু নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশের অনুমতি পায় বিএনপি। শেষপর্যন্ত সমাবেশ থেকে সংসদ ভেঙে দেওয়াসহ ১০ দফা দাবি জানিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ শেষ করে দলটি। সমাবেশের আগেই দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অনেকে আটক হন।

খালেদা জিয়াকে বিদেশ পাঠানো ও মুক্তির দাবি : দুর্নীতি মামলায় দীর্ঘদিন কারাগারে থাকার পর ২০২০ সালে করোনা বেড়ে গেলে মানবিক বিবেচনায় শর্ত সাপেক্ষে সরকার নির্বাহী আদেশে খালেদার সাজা স্থগিত করে মুক্তি দেয়। কিন্তু মুক্তি পেলেও শর্ত থাকায় দলীয় কোনো কর্মকান্ডে বেগম জিয়া অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। এমন অবস্থায় খালেদা জিয়ার স্থায়ী মুক্তি ও বিদেশে সুচিকিৎসার দাবি জানায় বিএনপি। এই দাবিতে বারবার রাজপথে নামার ঘোষণা দিলেও কার্যকর কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি দলটি। চলতি বছরেও পরিবারের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠাতে সরকারের কাছে বারবার আবেদন করা হয়। তাতে ফলও আসেনি।

যুগপৎ আন্দোলনে তৎপরতা : জাতীয় সরকার গঠনের স্বপ্ন দেখিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে যারা যুগপৎ আন্দোলন করতে ইচ্ছুক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চলতি বছরের ২৪ মে সংলাপ শুরু করে বিএনপি। আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপরেখা ঠিক করতেই দলটির এই সংলাপ। ২৪ ডিসেম্বর সারা দেশে গণমিছিল করার ঘোষণা দেয় বিএনপি। এর মধ্য দিয়ে তারা সরকারবিরোধী সমমনা দলগুলোকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করবে বলে জানায়। যুগপৎ আন্দোলনের লক্ষ্যে সমমনা ৩৫ দলের সঙ্গে ধারাবাহিক মতবিনিময়ও করে। যদিও জামায়াতের সঙ্গে প্রকাশ্য বৈঠক হয়নি, তবে জামায়াতও বিএনপির কর্মসূচিতে থাকার ঘোষণা দেয়।

ভেঙে গেছে ২০-দলীয় জোট : আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণের অংশ হিসেবে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট ভেঙে গেছে। বহুদিন এই জোট ছিল অকার্যকর। ১০ ডিসেম্বর ঢাকার বিভাগীয় গণসমাবেশের আগের দিন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ২০-দলীয় জোটের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান অনানুষ্ঠানিক সভায় শরিকদের ডেকে জানিয়ে দেন, এখন থেকে কেউ যেন ২০-দলীয় জোটের নাম ব্যবহার না করে। এর উদ্দেশ্য, দলগুলো যাতে যার যার অবস্থান থেকে যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত হয়। একসঙ্গে থাকার এক দশক পর এই জোট ভেঙে যাওয়ার পটভূমিতে ২০-দলীয় জোটে থাকা দলগুলো আলাদা প্ল্যাটফরম গড়তে উদ্যোগী হয়। দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে পাশে থাকা দলগুলোর নেতারা বিএনপির কাছ থেকে এমন আচরণে অনেকেই হতাশা প্রকাশ করছেন।

রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতে ২৭ দফার রূপরেখা : রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতে ১৯ ডিসেম্বর ২৭ রূপরেখা ঘোষণা করে বিএনপি।

দ্বাদশ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির এই রূপরেখা আলোচনার জন্ম দেয়। এতে ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন’ গঠন করে বর্তমান ‘অবৈধ আওয়ামী লীগ’ সরকারের গৃহীত সব অযৌক্তিক, বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক সাংবিধানিক সংশোধনী ও পরিবর্তনসমূহ রহিত ও সংশোধন করা, নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনাসহ নানা বিষয় তুলে ধরা হয়।

সর্বশেষ খবর