মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা
আসবে বিভিন্ন খাতে সংস্কার

আইএমএফের শর্ত পূরণের বাজেট

♦ জাতীয় নির্বাচন ও রাজনৈতিক পরিবেশ নিয়ে শঙ্কিত আইএমএফ ♦ বেড়েছে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম কমেছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি ♦ ব্যাংক খাতের জন্য হবে নতুন কমিশন, ধরা হবে বড় ঋণখেলাপিদের ♦ রাজস্ব আদায় বাড়াতে আবারও চাপ আসছে মধ্যবিত্তের ওপর

মানিক মুনতাসির

আইএমএফের শর্ত পূরণের বাজেট

আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট তৈরির মূল কাজ শুরু হতে যাচ্ছে খুব শিগগিরই। অবশ্য এর প্রস্তুতি শুরু হয়েছে আরও আগে। এ জন্য অংশীজনদের সঙ্গে প্রাক-বাজেট আলোচনাও শুরু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অর্থবিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এবারের বাজেটটি হবে আইএমএফের ঋণের শর্ত পূরণের বাজেট। কেননা অর্থনীতিতে যেসব সংস্কার কর্মসূচি আনা হবে বাজেটকে কেন্দ্র করে তার প্রায় সবই আইএমএফের পরামর্শে। অন্যথায় চলম ঋণ কর্মসূচির কিস্তি আটকে দিতে পারে সংস্থাটি। এতে করে নির্বাচনের আগে বা নির্বাচন পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক সংকট আরও বেড়ে যেতে পারে। ফলে আইএমএফের দেওয়া শর্তগুলোর একটা বড় প্রতিফলন ঘটবে আসছে বাজেটে।

এদিকে পরিকল্পনা ও মেয়াদ অনুযায়ী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র ১০ মাস বাকি রয়েছে। এরই মধ্যে প্রধান প্রধান দলগুলো তাদের সাংগঠনিক কাঠামো গোছানোর কাজ শুরু করেছে নির্বাচনকে সামনে রেখেই। এদিকে কাগজে-কলমে চলতি অর্থবছরের    (২০২২-২৩) বাকি রয়েছে আর মাত্র চার মাস। সে হিসাবে বর্তমান সরকারের হাতে রয়েছে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের অর্ধেক সময়। বাকি ছয় মাসের বাজেট বাস্তবায়ন করবে পরবর্তী নতুন সরকার। কিন্তু চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সঙ্গে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের একটি প্রকল্প নিয়েছে সরকার। যার প্রথম কিস্তি ইতোমধ্যে ছাড়ও করা হয়েছে। এ ঋণের বিপরীতে আরোপিত শর্ত অনুযায়ী সরকার এরই মধ্যে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোয় এর বিক্রিতে ভাটা পড়েছে। আগের বছরের ছয় মাসের তুলনায় চলতি বছরের একই সময়ে ৯ হাজার কোটি টাকা কমেছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি।

সংস্থাটির দেওয়া শর্ত অনুযায়ী, আগামী বছর থেকে জিডিপির দশমিক ৫ শতাংশ হারে বেশি রাজস্ব আদায় করতে হলে করকাঠামোয় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। এতে করজাল বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করে সরকার। যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন, করজাল বাড়ানোর পাশাপাশি কর ফাঁকি রোধে সরকারকে আরও সোচ্চার হতে হবে। কেননা প্রতি বছর রাঘববোয়ালরা বিপুল অঙ্কের কর ফাঁকি দিয়ে থাকে। তবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে হয়তো তারকা ব্যবসায়ীদের ক্ষ্যাপাতে চাইবে না সরকার। এ জন্য সেই মধ্যবিত্তশ্রেণির ওপরই করের বোঝা চাপবে নতুন করে।

এরই মধ্যে বৈশ্বিক সংকটের দোহাই দিয়ে জ্বালানি-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। ফলে সব ধরনের পণ্য ও সেবার দাম হু হু করে বাড়ছে। এতে নাভিশ্বাস উঠেছে মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে। এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আবদুল মজিদ মনে করেন, নতুন করে করের বোঝা চাপানো হলে এই শ্রেণির মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়বে। তবে আইএমএফের এ ঋণ কর্মসূচির ব্যাপক প্রশংসা করেছেন তিনি। তাঁর মতে, এটা একটা সময় উপযোগী ঋণ কর্মসূচি।

অন্যদিকে চলমান বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় শর্তসাপেক্ষে বাংলাদেশের জন্য ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। অনুমোদনের মাত্র দুই দিনের মাথায় এ ঋণের প্রথম কিস্তির অর্থ ছাড়ও করেছে সংস্থাটি, যা শর্তবিহীন। তবে দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের আগে আইএমএফের দেওয়া সংস্কার কার্যক্রম পর্যালোচনা করবে সংস্থাটি। শুধু তাই নয়, প্রথম ধাপে কী ধরনের সংস্কারমূলক কার্যক্রম হাতে নিয়েছে সরকার তার প্রতিফলন ঘটাতে হবে আসন্ন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটেও।

অর্থছাড়ের পর ১২৫ পৃষ্ঠার একটি মেমোরেন্ডাম প্রকাশ করেছে ওয়াশিংটনে অবস্থিত সংস্থাটির সদর দফতর। সেখানে এক পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতি, আর্থিক খাতের সংস্কার, সরকারের করণীয়সহ কয়েকটি ঝুঁকির কথা উল্লেখ করা হয়েছে ২৪ পৃষ্ঠায়। সেখানে বলা হয়েছে, অনুমোদিত চার বছর মেয়াদি ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ কর্মসূচিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং রাজনৈতিক পরিবেশ। এতে বলা হয়, এ কর্মসূচির প্রধান ঝুঁকি হলো আর্থিক বা আর্থিক নীতি শিথিল করার সুযোগ সীমিত প্রতিকূল বাস্তব ধাক্কার ঘটনা, সংকীর্ণ আর্থিক স্থান, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং রিজার্ভ লোকসান।

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও রাজনৈতিক পরিবেশ নিয়ে তারা যে উদ্বেগ দেখিয়েছে বা ঝুঁকির কথা বলেছে তা কিন্তু অমূলক নয়। কেননা আমাদের রাজনৈতিক পরিবেশ টেকসই বা সহনশীল নয়। এখানে অনেকগুলো অসহনীয় বিষয় রয়েছে যেগুলো অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকারক। তবে এটা নিঃসন্দেহে একটা ভালো ঋণ কর্মসূচি। আবার এটা ডলার সংকট এড়াতে খুব একটা কার্যকর ভূমিকা রাখবে না। কারণ পরিমাণ খুবই কম। তবে এটা আমাদের জন্য ইতিবাচক যে, আইএমএফ এখন সংকট এড়াতে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বড় একটা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এটা অন্যদের কাছেও এক ধরনের ইতিবাচত বার্তা দেবে বলে তিনি মনে করেন। এদিকে সংস্থাটির দেওয়া শর্ত মোতাবেক এ ঋণপ্রাপ্তির বিপরীতে বাংলাদেশকে আগামী চার বছর অর্থনীতিতে ব্যাপক সংস্কার আনতে হবে। ২০২৬ সালের মধ্যেই ধাপে ধাপে নানা খাতের এসব সংস্কার সম্পন্ন করতে হবে। আবার প্রতি কিস্তি ছাড়ের আগে সংস্কারমূলক কার্যক্রম পর্যালোচনা করা হবে। এর অংশ হিসেবে সরকার ইতোমধ্যে গ্যাস-বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়িয়েছে। তবে রাজস্ব খাতের সংস্কার আনতে হবে খুবই বিস্তৃত পরিসরে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে শুল্ক ও ভ্যাট বিভাগে ঝুঁকিব্যবস্থা ইউনিট গঠন করতে হবে। বার্ষিক আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে পুনঃতফসিল করা ঋণ ও খেলাপি ঋণের তথ্য অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন সংসদে উপস্থাপন করতে হবে। জলবায়ু ও পরিবেশবান্ধব টেকসই ক্রয় নীতিমালা ও সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। সুদের হারের করিডোর পদ্ধতি চালু, বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন বাজারভিত্তিক করা, আইএমএফের শর্তানুসারে রিজার্ভের হিসাব, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি নির্ধারণ সময় উপযোগী করতে হবে। সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমানো, রাষ্ট্রীয় কোষাগারে আয় জমা একক হিসাব চালুর নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। জিডিপির প্রান্তিক বা কোয়ার্টার হিসাব প্রদান, ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণে জলবায়ুজনিত ঝুঁকি নির্ধারণ সংক্রান্ত নীতিমালা চালু করতে হবে। ব্যাংক খাতের সুশাসনের জন্য একটি কমিশন গঠন করতে হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে কর অব্যাহতি কমিয়ে আনতে হবে। মধ্যমেয়াদি রাজস্ব কৌশল বাস্তবায়ন, কর সংক্রান্ত নিয়মকানুন প্রতিপালনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। অর্থবিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। তবে ধাপে ধাপে এসবের বিস্তর প্রতিফলন ঘটবে প্রতি বছরের বাজেটে। আসছে বাজেটেও এর প্রভাব থাকবে অনেক বেশি বলে তারা মনে করেন।

সর্বশেষ খবর