শীত শেষে বেড়েছে গরমের তীব্রতা। সেই সঙ্গে রাজধানীজুড়ে কিউলেক্স মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ মানুষ। দিনের আলো যত কমে মশার দাপট তত বাড়ে। ঘরে-বাইরে, অফিস-আদালতে, বস্তি থেকে অভিজাত এলাকা, সবখানেই মশার আক্রমণ। অথচ কিউলেক্স মশার মৌসুম শেষ হলেও সবখানে ছোট এই পতঙ্গের দাপট রয়েছে। এতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে নাগরিক জীবন। তবে কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, শুষ্ক মৌসুম হওয়ায় কিউলেক্স মশার উপদ্রব বেশি। কিউলেক্স মশার প্রজননস্থলে সিটি করপোরেশন আগে থেকে ভালোভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করলে এত উপদ্রব হতো না। তবে বর্ষা আসন্ন। এখন থেকে সিটি করপোরেশনকে এডিস মশার বংশবিস্তার রোধে প্রস্তুতি নিতে হবে। না হয় এবারও ভয়াবহ হবে ডেঙ্গু পরিস্থিতি।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এই সময়টা হচ্ছে কিউলেক্স মশার প্রজনন সময়। আর এই কিউলেক্স মশা জন্মায় পুকুর, ডোবা, নর্দমায়। আর দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় অনেক ডোবা ও নর্দমার উপস্থিতি আছে। সে জন্য মশার উপস্থিতি বেশি। সিটি করপোরেশন এসব ডোবা ও নর্দমা পরিষ্কার করলে কিউলেক্স মশার এত উপদ্রব হতো না।
তিনি বলেন, সামনে আসছে বর্ষা মৌসুম। বৃষ্টি হলেই এডিস মশা বাড়তে শুরু করবে। সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এডিস মশার বংশবিস্তার রোধে আগাম প্রস্তুতি না নিলে ভয়াবহতা ছড়াতে পারে ডেঙ্গু। এই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নগরবাসীকে সম্পৃক্ত করে আগে থেকে প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। সবার নিজ নিজ আঙিনা পরিষ্কার রাখতে হবে। বৃষ্টির সময় পাত্রে জমে থাকা পানি ফেলে দিতে হবে। প্রয়োজনবিহীন খালি পাত্র রাখা যাবে না। সব মিলিয়ে নগরবাসীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও সচেতন হতে হবে।
অন্যদিকে মশক নিয়ন্ত্রণে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা খরচের পরও সুফল না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ নাগরিকরা। তারা বলছেন, ঘরে না হয় কয়েল বা মশারি টানিয়ে মশা থেকে পালিয়ে থাকা যায়; কিন্তু বাস, ট্রেন ও লঞ্চেও মশা কামড়ায়। বাসাবাড়ি, অফিস, বাজার, উন্মুক্ত স্থান, সড়ক, পার্ক, খেলার মাঠ কোথাও মশা থেকে মুক্তি মিলছে না। তাহলে এত টাকা খরচ করার ফলটা কী? খিলগাঁও এলাকার চা দোকানি আশরাফ আলী জানান, মানুষ চা খাওয়ার জন্য বসেও মশার জন্য শান্তি পায় না। মশার কয়েল জ্বালিয়ে রেহাই পাচ্ছি না। একই অবস্থা সদরঘাট এবং পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকাতেও। সোয়ারীঘাট এলাকার ব্যবসায়ী আনোয়ার পারভেজ জানান, মশার যন্ত্রণায় কোথাও পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। দোকানের মশা তাড়াতে তিনি ইলেকট্রিক ব্যাট কিনে নিয়েছেন। রামপুরার বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী জাহিদ হাসান জানান, দিনের বেলায়ও মশা কামড়ায়। অনেক সময় দিনেও তার স্ত্রী ছোট বাচ্চা নিয়ে মশারির ভিতর বসে থাকেন। তবে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নিয়মিত মশক নিধন কার্যক্রম চালাচ্ছেন তারা। আগে সাত দিন অন্তর অন্তর ফগিং করত ডিএসসিসি। এখন চার দিন পরপর ফগিং করা হয়। উত্তর সিটি করপোরেশন নিয়মিতই হটস্পট চিহ্নিত করে সেখানে মশক নিধন অভিযান চালাচ্ছে। একই সঙ্গে চলতি মাসের শুরু থেকে মশক নিধন কর্মী ও মশক সুপারভাইজার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে সংস্থাটি। এ প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আওতায় ইতোমধ্যে অঞ্চল-১, ২, ৩, ৪, ৫ ও ৬-এর মশক নিধন কর্মীদের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে। প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে তাত্ত্বিক বিষয় ছাড়াও হাতে-কলমে মশার প্রজননস্থল শনাক্তকরণ ও ধ্বংস এবং কীটনাশক প্রয়োগ পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়। আজ অঞ্চল-৭ ও ৮ এ কর্মরত মশক নিধন কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। জানতে চাইলে ডিএসসিসির ভারপ্রাপ্ত প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণে ডিএসসিসিতে ১১০ জন মশক নিধনকর্মী কাজ করছে। যারা সকাল-বিকাল নিয়মিত ওষুধ স্প্রে করছে। এ জন্য ডিএসসিসি এলাকার মশা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তিনি বলেন, এডিস মশার উৎস নির্মূলের লক্ষ্যে বরাবরের মতো এবারও ডিএসসিসি শিগগিরই সপ্তাহব্যাপী স্পেশাল ক্র্যাশ প্রোগ্রাম শুরু করবে। মশার উৎপাত নিয়ন্ত্রণে আসার পূর্ব পর্যন্ত এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। ঢাকার দুই সিটি সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার দুই সিটিতে প্রায় ৭৫০ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট ও কাভার্ড ড্রেন রয়েছে। যেগুলোতে মশার ওষুধ ছিটাতে পারে না। পাশাপাশি প্লাস্টিক দ্রব্যসামগ্রী, পলিথিন, ডাবের খোসাসহ বিভিন্ন আবর্জনায় ওই ড্রেনগুলো ভরাট থাকে। দুই ভবনের মাঝখানের জায়গাগুলো আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। যে কারণে ড্রেন দিয়ে পানি নিষ্কাশন হয় না। জমাটবদ্ধ এসব পানিতে কিউলেক্স ভয়াবহরূপে বংশবিস্তার করছে। এসব স্থানে মশার প্রজনন ধ্বংস করতে কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করছে না। আর জলাশয়, খাল, নর্দমা ও যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকা প্লাস্টিক দ্রব্যসামগ্রী ও ডাবের খোসার পানিতে ভয়াবহরূপে মশার বংশ বিস্তার ঘটাচ্ছে। এসব কারণে মশক নিধনে দুই সিটি পর্যাপ্ত অর্থ খরচ করলেও নগরবাসীকে মশার ধকল সইতে হচ্ছে।