শনিবার, ৬ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

শহরজুড়েই শব্দসন্ত্রাস

জিন্নাতুন নূর

শহরজুড়েই শব্দসন্ত্রাস

রাজধানীর মিরপুর-১০ নম্বর গোলচক্কর এলাকায় গত ২ মে রোগীবাহী একটি অ্যাম্বুলেন্স যানজট ঠেলে হাসপাতালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। অ্যাম্বুলেন্সটির ঠিক পেছনেই একটি পিকআপ ভ্যান ওভারটেক করার জন্য অ্যাম্বুলেন্সটিকে অনবরত হর্ন দিয়ে যাচ্ছিল। অ্যাম্বুলেন্সে থাকা রোগীর এক স্বজন পিকআপ চালককে হর্ন বাজাতে নিষেধ করলে দুজনের মধ্যে তর্ক লেগে যায়। পরে দায়িত্বরত কনস্টেবল এসে পরিস্থিতি সামাল দেন।

এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত শব্দদূষণের ঘটনাকে বিশেষজ্ঞরা এখন ‘শব্দসন্ত্রাস’ বলে অভিহিত করছেন। শব্দদূষণের কারণে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষ এখন আর স্বস্তিতে ঢাকার রাস্তায় হাঁটতে পারেন না। সড়কে বের হলেই গাড়ির অপ্রয়োজনীয় হর্নের শব্দে কান পাতা কষ্টকর হয়ে পড়ে। মোটরসাইকেল চালকরা আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় অকারণেই হর্ন বাজান। আবার নতুন উপদ্রব হিসেবে মোটরচালিত রিকশার হর্ন শহরের শব্দদূষণের মাত্রাকে ভয়াবহ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। দুঃখজনক হলেও শব্দদূষণে বিশ্বের শীর্ষ শহর এখন ঢাকা। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনএপি) সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ‘ফ্রন্টিয়ারস ২০২২ : নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে দেখা যায়, শব্দদূষণের তালিকায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থান প্রথম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আবাসিক এলাকার জন্য অনুমতিযোগ্য শব্দের মাত্রা ৫৫ ডিবি (ডেসিবেল) এবং বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডিবি। কিন্তু ঢাকার শব্দের মাত্রা সেখানে ১১৯ ডিবি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘গাড়ির শব্দ, উড়োজাহাজ চলাচল, রেল চলাচল, যন্ত্রপাতি, শিল্প এবং বিভিন্ন উৎসব ও বিনোদনমূলক আয়োজনের শব্দদূষণ মানুষের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন জানান, ঢাকা শহর সহনীয় মাত্রার চেয়ে তিন গুণ তীব্রতার শব্দদূষণে আক্রান্ত। এর ফলে প্রায় অর্ধ কোটি মানুষ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। তিনি আরও জানান, ৯টি সিটি করপোরেশন এলাকায় ঘোষিত নীরব এলাকা শব্দমুক্ত রাখার জন্য প্রয়োজনে বিদ্যমান আইন পরিবর্তন করে নতুন আইন প্রবর্তন এবং কঠোরভাবে বিদ্যমান আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি আগামী দুই মাসের মধ্যে রাজধানীতে শব্দদূষণ রোধে হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার বন্ধের লক্ষ্য নির্ধারণ করার বিষয়েও ঘোষণা দেন।

পরিবেশ অধিদফতরের এক জরিপে জানা যায়, মাত্রাতিরিক্ত শব্দের কারণে ইতোমধ্যে দেশের প্রায় ১২ শতাংশ মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস পেয়েছে। একই সঙ্গে বর্তমানে শব্দদূষণের যে মাত্রা তা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে ২০২৩ সাল নাগাদ এক-তৃতীয়াংশ মানুষ এর দ্বারা আক্রান্ত হবে। তারা বধিরতায় আক্রান্ত তো হবেই, পাশাপাশি ক্ষুধামন্দা, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, হাইপারটেনশন, আলসার, স্মরণশক্তি হ্রাস, স্নায়ুর সমস্যা এবং কাজে মনোযোগী হতে না পারার সমস্যায় ভুগতে পারেন।

শব্দদূষণ বিধিমালা ২০০৬ অনুযায়ী ঢাকার জন্য দিনের বেলা শব্দের আদর্শ মান ৬০ ডেসিবেল। অথচ স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) এক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় শব্দের গড় মাত্রা ৭৬ দশমিক ৮০ ডেসিবেল এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় শব্দের গড় মাত্রা ৮০ দশমিক ৫৬ ডেসিবেল। আগে যেখানে রাজধানীতে গড়ে ১২ ঘণ্টা সময় ধরে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রায় শব্দদূষণ হতো। এখন তা ১৪ ঘণ্টা ছাড়িয়ে গেছে। ক্যাপস গত জানুয়ারি মাসে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সড়কের মোট ৮২টি সংযোগস্থানের শব্দের মাত্রা পরিমাপ করে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার ৩৭টি এবং উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার ৪৫টি স্থান। গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের শব্দের তীব্রতা মানমাত্রা ছাড়িয়েছে। নগরের বিভিন্ন স্থানে সাধারণভাবে শব্দের গ্রহণযোগ্য মানমাত্রার থেকে প্রায় ১ দশমিক ৩ থেকে ২ গুণ বেশি শব্দ পাওয়া যায়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় শব্দের গড় মাত্রা পাওয়া গেছে ৭৬ দশমিক ৮০ ডেসিবেল। আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে শব্দের গড় মাত্রা পাওয়া যায় ৮০ দশমিক ৫৬ ডেসিবেল। গবেষণায় শব্দদূষণের বিভিন্ন উৎসের মধ্যে নির্মাণকাজ যেমন ইট ও পাথর ভাঙার মেশিন, টাইলস কাটার মেশিন, ভবন ভাঙার শব্দ, কল-কারখানার শব্দ, জেনারেটরের শব্দ ইত্যাদি চিহ্নিত করা হয়।

এ ছাড়াও এবার খ্রিস্টীয় নববর্ষ উদযাপনের সময় জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর (৯৯৯) তে শব্দদূষণ নিয়ে ৩৬৫টি অভিযোগ আসে। এ সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে আতশবাজি, পটকা ফোটানো, উচ্চ শব্দে গান বাজানোর অভিযোগ আসে। এ ছাড়া বিয়ে ও জন্মদিনের উৎসবে নগরীর বিভিন্ন স্থানে এখন গভীর রাতে আতশবাজি ও গানবাজনার উচ্চ শব্দে মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে।

ক্যাপস-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা ঢাকায় প্রতি বছর ৭০টি স্থানে শব্দের মান পরিমাপ করে থাকি। এসব স্থানে দিনে ও রাতে কোথাও নির্ধারিত মানমাত্রা পাওয়া যায় না। বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকাগুলোতেও নির্ধারিত মানমাত্রার প্রায় দ্বিগুণ শব্দ পাওয়া যায়। যানবাহন ছাড়াও নির্মাণ প্রকল্প, গৃহস্থালির দৈনন্দিন কাজ থেকে শব্দদূষণ হচ্ছে। আর বর্তমানে সামাজিক, সাংস্কৃৃতিক ও ধর্মীয় উৎসবগুলো থেকে অত্যধিক শব্দদূষণের সৃষ্টি হচ্ছে। এর সঙ্গে বর্ষ উদযাপনও শব্দদূষণের মাত্রা বৃদ্ধি করছে। সাকরাইন, শবেবরাত, অন্যান্য ধর্মীয় উৎসবে বাজি ও আতশবাজি পোড়ানো হচ্ছে। বিশেষ করে ৩১ ডিসেম্বর বর্ষবরণ উদযাপনে শব্দের দূষণ বেশি হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর