ইউরোপের ছোট দ্বীপরাষ্ট্র গ্রিক-সাইপ্রাসে ইসরায়েলের নাগরিকদের বসতি স্থাপন নিয়ে সম্প্রতি নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক দিক থেকে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। সাইপ্রাসে ইতোমধ্যেই প্রায় ১৫ হাজার ইসরায়েলি স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছেন। বিশেষ করে লার্নাকা ও লিমাসল শহরে ব্যাপক হারে জমি ও অ্যাপার্টমেন্ট কেনার ঘটনা জনমনে প্রশ্ন তুলেছে। গ্রিক-সাইপ্রাস কি ধীরে ধীরে ‘নতুন ইসরায়েল’-এ রূপ নিচ্ছে?
তুরস্কের সংবাদমাধ্যম টার্কি টুডে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বিগত কয়েক মাসে ইসরায়েলি বিনিয়োগকারীরা গ্রিক-সাইপ্রাসে বিপুলসংখ্যক সম্পত্তি কিনেছেন। অনেকেই বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট, জমি ও ব্যবসায়িক ভবন কেনেন। এ নিয়ে স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে বাড়ছে অসন্তোষ ও নিরাপত্তা সংশয়। ইহুদি আল্ট্রা-অর্থডক্স সংগঠন ‘ছাবাড’ ইতোমধ্যেই লার্নাকা ও লিমাসলে গড়ে তুলেছে সিনাগগ, কোশার খাবার কেন্দ্র, কিন্ডারগার্টেন, কবরস্থান ও ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এসব স্থাপনা থেকে স্পষ্ট, এটি শুধু পর্যটন বা অস্থায়ী থাকার উদ্দেশ্যে নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি একটি গোষ্ঠীভিত্তিক স্থায়ী বসতি স্থাপনের আয়োজন চলছে। বিরোধী রাজনৈতিক দল একেল-এর নেতা স্টেফানোস স্তেফানু সরাসরি অভিযোগ করে বলেন, ‘গ্রিক সাইপ্রাস ধীরে ধীরে একটি ইসরায়েলি প্রভাবাধীন অঞ্চলে পরিণত হচ্ছে। এটি শুধু আবাসন সমস্যা নয়, বরং এটি আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন।’ তুরস্ক ও উত্তরের সাইপ্রাস প্রশাসনের গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞরা এই ইসরায়েলি জনবসতিকে কেবল অর্থনৈতিক বিনিয়োগ হিসেবে না দেখে, এটিকে একটি সম্ভাব্য ‘গোপন গোয়েন্দা অপারেশন বেস’ হিসেবে বিবেচনা করছেন। পূর্ব ভূমধ্যসাগরে মার্কিন ও ইসরায়েলি সামরিক নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের কৌশলের অংশ বলেও ধারণা করা হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের ওপর ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদি নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি জোরদারের জন্য এটি একটি কৌশলগত পরিকল্পনা হতে পারে। এতে করে গ্রিক সাইপ্রাস হয়ে উঠতে পারে এক ধরনের ‘অঘোষিত সামরিক ও গোয়েন্দা ঘাঁটি’।
ইসরায়েলি নাগরিকদের গ্রিক সাইপ্রাসে হঠাৎ বসতি স্থাপন এবং ব্যাপক ভূমি দখলের বিষয়টি এখন আর নিছক রিয়েল এস্টেট ইস্যুতে সীমাবদ্ধ নেই। এটি একটি রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় জনগণ, রাজনৈতিক দল এবং আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বিষয়টিকে ঘিরে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
তুরস্ক ও উত্তর সাইপ্রাস এই পরিস্থিতিকে বহুস্তরবিশিষ্ট ঝুঁকি হিসেবে দেখছে। তুরস্কের দৈনিক পত্রিকা মিল্লিয়েতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিশ্লেষকরা বলছেন, গ্রিক সাইপ্রাসে ইসরায়েলি জনসংখ্যা বৃদ্ধি কেবল জনসংখ্যাগত পরিবর্তন নয়, বরং একটি জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি হিসেবেও দেখা উচিত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদিদের অন্যতম আশ্রয়স্থল ছিল ইউরোপের ছোট দ্বীপরাষ্ট্র সাইপ্রাস। হিটলারের নাৎসি বাহিনীর হাত থেকে প্রাণে বাঁচতে সেই সময় লাখো ইহুদি এই দেশে আশ্রয় নেন। সাম্প্রতিক ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের সময় ভয়াবহ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনায় সময়ও অনেক ইসরায়েলি সাইপ্রাসে পাড়ি জমান। এমনকি গুঞ্জন উঠেঠিল, প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুও আশ্রয়ের জন্য ওই সময় সাইপ্রাসে গিয়েছিলেন। ফলে দেশটির সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই উষ্ণ ও সহানুভূতিশীল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েলিদের রিয়েল এস্টেট খাতে ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগ এবং জমি কেনার প্রবণতা সাইপ্রাসে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
অন্যদিকে এর আগে হামাসের আল আকসা তুফান অভিযান শুরু হওয়ার পর হাজার হাজার ইহুদি ইসরায়েল থেকে পালিয়ে ইউরোপের দেশ গ্রিসে গিয়েছেন এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের ঘটনা অনেক বেড়ে গেছে বলে হিব্রু ভাষার একটি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে।
এ ছাড়া ইরানের বার্তা সংস্থা তাসনিমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাজার হাজার ইসরায়েলি পরিবার এখন গ্রিসকে তাদের অস্থায়ী বা স্থায়ী আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছে। আর এ ব্যাপক সংখ্যক ইসরায়েলির গ্রিসে পাড়ি জমানোর কারণে সেখানে অ্যাপার্টমেন্ট কেনার চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। চাহিদার তুলনায় আবাসনের পরিমাণ কম থাকায় বাড়িভাড়াও অনেক বেড়ে গেছে।
এদিকে ২ জুলাই ফরাসি পত্রিকা লা ক্রোয়ায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে ইসরায়েল ছাড়ানো প্রায় ৮০ হাজার নাগরিকের মধ্যে প্রায় ১০ হাজার গ্রিসকে তাদের নতুন ঠিকানা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
প্রতিশ্রুত ভূমি ও যুদ্ধ থেকে দূরে : গ্রিসে বসতি গড়ছেন ইসরায়েলিরা এই শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, কেউ কেউ পেশাগত কারণে গ্রিসে এসেছেন, আবার অনেকেই ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও উত্তেজনা থেকে মুক্তির আশায় দেশ ছাড়ছেন।
প্রতিবেদনটিতে এক ব্যবসায়িক পরামর্শদাতার কথা তুলে ধরা হয়, যিনি হামাসের হামলার পরপরই তেল আবিব থেকে তার দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে গ্রিসে চলে আসেন। তিনি বলেন, ইসরায়েল আর গণতান্ত্রিক দেশ নয়। গাজায় এই যুদ্ধ অবৈধ এবং ন্যায়সংগত নয়। তিনি আরও জানান, ইসরায়েলে প্রকাশ্যে এমন মতপ্রকাশ করলে অনেক সময় ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকার হতে হয়।