শনিবার, ১০ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

হারিয়ে যাচ্ছে সেই ঘানি

আবদুর রহমান টুলু, বগুড়া

হারিয়ে যাচ্ছে সেই ঘানি

বাঙালির ঐতিহ্যবাহী ঘানির সরিষার তেল ছাড়া একসময় ভালো অনুষ্ঠান হয়নি। বিয়ে, ঈদ, আকিকা, পূজা-পার্বণ, পারিবারিক অনুষ্ঠানে বা অভিজাত পরিবারের জন্য ঘানির সরিষার তেল ছিল সংস্কৃতির বিষয়। গ্রামে বা শহরে সমান জনপ্রিয় ছিল এই ঘানির তেল। কালের বিবর্তন আর আধুনিক সভ্যতার ক্রমবিকাশে বগুড়ায় এখন আর চোখে পড়ে না ঘানি। গরু দিয়ে কাঠের ঘানি ঘুরিয়ে সরিষা মাড়িয়ে তেল বের করার দৃশ্য আর দেখা যায় না। সময়ের প্রবাহে ঘানির প্রচলন এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। সেই সঙ্গে বিলুপ্ত হতে চলেছে চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতির এই ঐতিহ্য। ঘানির চার পাশে একসময় গরু বা অন্য কোনো প্রাণী জোয়াল কাঁধে নিয়ে ঘুরত। আর ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ হতো। আশপাশের মানুষ চোখ বন্ধ করে বুঝে নিত সরিষা মাড়াই করে কলু সম্প্রদায় তৈরি করছে খাঁটিমানের সরিষার তেল। ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজের সঙ্গে পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ত সরিষার সুগন্ধ। ছড়িয়ে থাকত তেলের ঝাঁঝালো অংশ। কিন্তু এখন আর সেই ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ শোনা যায় না। বৈদ্যুতিক যন্ত্রের ব্যবহারে হারিয়ে যেতে বসেছে আদি কালের ঘানি শিল্পের ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ। বগুড়ার কাহালু, শিবগঞ্জ, দুপচাঁচিয়া, আদমদীঘি, ধুনট, নন্দীগ্রাম উপজেলার গ্রামে গ্রামে ঘানিশিল্পের ব্যাপক প্রচলন ছিল। বিশেষ করে শিবগঞ্জ উপজেলায় ঘানিশিল্প বেশি ছিল। প্রবীণ ব্যক্তিরা বলছেন, মানুষের প্রতিদিনের চাহিদা মেটাতে গিয়ে ঘানিশিল্পের শুরু হয়। ঘানিতে ভালো ও খাঁটিমানের সরিষার তেল পাওয়া যেত বলে এই ঘানির তেল পেতে মানুষ মুখিয়ে থাকত। একদিকে মানে খাঁটি অপরদিকে পরিবারের সদস্যদের জন্য ভালো ভোজ্য তেল- সেকারণে বগুড়া ও বগুড়ার আশপাশের জেলায় ঘানির তেল ছিল বিখ্যাত। বলা হয় স্বাধীনতার পরও বগুড়ার ঘানিতে তৈরি সরিষার তেল নওগাঁ, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, নাটোর জেলায় বিক্রি হতো। ঘানির তেলের মানের কারণে চাহিদা সৃষ্টি হয়েছিল প্রচুর। কালের বিবর্তন আর আধুনিক সভ্যতার ক্রমবিকাশে বর্তমানে বগুড়ার সব উপজেলা থেকে সরিষার তেল তৈরিকারক কলু সম্প্রদায় প্রায় বিলুপ্তির পথে। যদিও দুই-একটি পরিবার এখনো দেখা যায় শিবগঞ্জ উপজেলার একেবারে পল্লীতে।

শিবগঞ্জের পৌর এলাকার কলুমগাড়ি গ্রামের আবু জাফর সিদ্দিক ঘানিতে খাঁটি সরিষার তেল ভাঙতেন। তিনি ছয় মাস আগে নানা প্রতিকূলতার কারণে সেটি বন্ধ করে দিয়েছেন। আবু জাফর সিদ্দিক জানান, পৈতৃক সূত্রে পাওয়া এই ব্যবসা তারা করে আসছিলেন। আবু জাফর তার বংশের তিন পুরুষের এ পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। তার দাদা মৃত মানিক উল্লাহ ঘানির খাঁটি সরিষার তেল বিক্রি করতেন। দাদার পর বাবা মৃত হোসেন আলীও একই পেশার জীবিকা নির্বাহ করেছেন। বর্তমানে সত্তর বছর বয়সে এসে তিনি এ শিল্পটি আর টিকিয়ে রাখতে পারেননি। বর্তমানে ২ ছেলে, ৫ মেয়ে ও স্ত্রী রোকেয়া বেগমকে নিয়ে তার সংসার। বাপ-দাদার এই পেশা ছাড়তে তিনি এখনো নারাজ। আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু হওয়ায় তিনি এ পেশা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। বর্তমানে তার বাড়িতে শুধু ঘানিশিল্পের কিছু চিহ্ন রয়েছে। আবু জাফর আরও জানান, ঘানির সঙ্গে একটি গরুর চোখ বেঁধে কাঁধে জোয়াল লাগিয়ে দেওয়া হতো। আর গরুটি দিনভর ঘানির চারপাশে আপন মনে ঘুরতে থাকত। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঘানিতে তেল ভাঙার কাজ করতেন তিনি। এক সময় ঘানির নল দিয়ে টিপটিপ করে তেল বের হতো। তবে স্ত্রী রোকেয়া বেগম ৪৮ বছর ধরে প্রতিনিয়তই স্বামীকে ঘানিতে সরিষা মাড়িয়ে সহযোগিতা করেছেন। তার ঘানিতে এক মণ সরিষা থেকে ১৫ থেকে ১৬ লিটার তেল পাওয়া যেত। তিনি প্রতিদিন ২৭ কেজি সরিষা ঘানিতে ভাঙতেন এবং তা থেকে গড়ে প্রায় ৮ থেকে ৯ লিটার তেল বের হতো। ওই তেল মাটির কলসিতে করে মহাস্থান ও শিবগঞ্জ হাট বারে বিক্রি করতে নিয়ে যেতেন। বাজারে মেশিনে ভাঙানো সরিষা তেলের চেয়ে তার তেলের চাহিদা অনেক বেশি ছিল। তিনি প্রতি লিটার তেল বিক্রি করেন ১৮০ টাকা দরে। প্রবীণ ব্যক্তি আজিজার রহমান জানান, তিনি কলু জাফরের কাছ থেকে দীর্ঘদিন ধরে সরিষার তেল কিনছেন। পরিবারের সদস্যদের জন্য ভালো মানের ভোজ্য তেল ব্যবহার করা হতো। এক সময় গৃহস্থরা খাঁটি সরিষার তেল সব ধরনের রান্নার কাজে ব্যবহার করত। এ ছাড়া ঈদ, পূজা, ঘরোয়া কোনো অনুষ্ঠানে ঘানির তেলের রান্নার একটা রেওয়াজ ছিল। সেটিও এখন নেই। এক কথায় ঘানির সরিষার তেল ছাড়া সে সময় রান্না হতো না। কিন্তু ইদানীং এই তেল পাওয়ায় যাচ্ছে না। সবই এখন মেশিনে তৈরি তেল। প্রসঙ্গত, ঘানি শিল্প হারিয়ে গেলেও সরিষা চাষ কমেনি বগুড়ায়। এখনো কৃষকরা শ্রম দিয়ে মমতায় ফলিয়ে যাচ্ছেন সরিষা। মানে, দামে, হাত পেরিয়ে মেশিনে তৈরি হয়ে সরিষা তেল আবার আসছে ঘরে ঘরে। তবে সেটি মেশিনের মাড়াই করা সরিষার তেল।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর