শনিবার, ১০ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা
সাক্ষাৎকার - শফিউল আজিম

ইউরোপ রুটে ডানা মেলবে বিমান

ঢাকা-নিউইয়র্ক, ঢাকা-চেন্নাই ফ্লাইট চালুর পরিকল্পনা চলছে, গালফ এয়ারের সঙ্গে কোড শেয়ারিংয়ের চুক্তিতে ইউরোপে যাত্রীসেবা

জয়শ্রী ভাদুড়ী

ইউরোপ রুটে ডানা মেলবে বিমান

চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ৫১ বছরের অগ্রযাত্রায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর জন্য নিয়ে আসা ম্যাকডনেল ডগলাস ডিসি-৩ উড়োজাহাজ দিয়ে ঢাকা-লন্ডন রুটে যাত্রা করে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইনস বিমান। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের সমস্যা, সম্ভাবনা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ নিয়ে কথা বলেছেন বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিইও শফিউল আজিম। শফিউল আজিম বলেন, ‘আন্তর্জাতিক ২১ ও অভ্যন্তরীণ সাত রুটে চলছে বিমান। ঢাকা-টরন্টো রুটে আমরা ভালো সাড়া পাচ্ছি। আমাদের পরবর্তী পরিকল্পনা রয়েছে ঢাকা-নিউইয়র্ক ফ্লাইট। সেপ্টেম্বরে চালু হচ্ছে ঢাকা-নারিতা ফ্লাইট। সেখান থেকে সিডনি পর্যন্ত যাওয়া যায় কি না সে বিষয়ে আলোচনা চলছে। ঢাকা-চেন্নাই ফ্লাইট চালু করব আমরা। বর্তমানে বিমানের বহরে রয়েছে ২১টি উড়োজাহাজ। এর মধ্যে ড্রিমলাইনার থেকে শুরু করে দূরপাল্লায় চলতে সক্ষম ১০টি অত্যাধুনিক উড়োজাহাজ রয়েছে। অভ্যন্তরীণ রুটগুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সৈয়দপুরে যাত্রী চাহিদা রয়েছে। কিন্তু উড়োজাহাজ সংকটের কারণে আমরা ফ্লাইট সংখ্যা বাড়াতে পারছি না। যে উড়োজাহাজগুলো রয়েছে সেগুলোরও বয়স বাড়ছে। বিমানের বর্তমানে দূরবর্তী রুট রয়েছে লন্ডন, টরন্টো।’

বিমানের রুট নিয়ে কী পরিকল্পনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঢাকা-নিউইয়র্ক রুট চালুর কাজ এবং ঢাকা-চেন্নাই ফ্লাইট চালুর পরিকল্পনা চলছে। অভ্যন্তরীণ রুটে মাত্র চারটি উড়োজাহাজ আছে, আর স্টেশন সাতটি। কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সৈয়দপুর রুটে ভালো  চলছে। কিন্তু ফ্লাইট বাড়াতে পারছি না। আমাদের এয়ারক্রাফটের মান পৃথিবীর যে কোনো এয়ারলাইনসের অত্যাধুনিক উড়োজাহাজের সমকক্ষ। চাহিদার সঙ্গে বিমানের সংখ্যার ঘাটতি হচ্ছে। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সব ধরনের উড়োজাহাজের বৈমানিকদের নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান আছে। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় গারুদা এয়ারলাইনসের সঙ্গে আমরা চুক্তিতে যাচ্ছি। তারা আমাদের এক বছরের জন্য বৈমানিক দেবে। বিমানের ব্যবহার বাড়াতে চাইলে পাইলট বা বৈমানিক প্রয়োজন রয়েছে। আমরা ১০০ কেবিন ক্রু, ক্যাডেট পাইলট নিয়োগ দিয়েছি। আমাদের বিদ্যমান বিমানগুলোকে আরও বেশি ব্যবহার করতে পারব।’ শফিউল আজিম বলেন, ‘বিমান চাইলেই কেনা যায় না, দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। অনেক অর্থের প্রয়োজন হয়। আমরা রুট শেয়ারিংয়ের চিন্তা করছি। এজন্য বিভিন্ন এয়ারলাইনসের সঙ্গে কোড শেয়ারিং, ইন্টারলাইন করে জাপানের নারিতা থেকে অন্য এয়ারলাইনস আমাদের বোর্ডিং কার্ড নিয়ে যাত্রীকে লস অ্যাঞ্জেলেস কিংবা সিডনি পৌঁছে দেবে। অর্থাৎ বিমান ওই গন্তব্যে না গেলেও বিমানের সেবা নিয়ে ওইসব গন্তব্যে যাত্রীরা পৌঁছাতে পারবেন। একইভাবে গালফ এয়ারের সঙ্গে প্রথমবারের মতো এ মাসেই কোড শেয়ারিংয়ের চুক্তি করতে যাচ্ছি। ইউরোপে তাদের ফ্লাইট চলমান আছে। একটা নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাত্রীদের পৌঁছে দেবে। চীনের গুয়াংজুতে আমাদের ফ্লাইট চলমান ছিল যেটা বন্ধ হয়ে গেছে। সেটা চালু করতে দুই দেশের সরকার আলোচনা করছে। আশা করছি ইতিবাচক বার্তা পাব। ম্যানচেস্টারে আমরা ভালো সাড়া পাচ্ছি। ম্যানচেস্টার থেকে কীভাবে অন্য জায়গায় যাওয়া যায় সে চেষ্টা চলছে। কানাডার টরন্টো থেকে অন্য শহরে ইন্টারলাইন করে ফ্লাইট পরিচালনার পরিকল্পনা করছি আমরা। তাতে বিমানের প্রসার ঘটবে। নিজেদের সক্ষমতা এবং শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে গন্তব্য বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।’ যাত্রীসেবার মান বাড়াতে কী ধরনের উদ্যোগ রয়েছে- জানতে চাইলে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিইও শফিউল আজিম বলেন, ‘আমরা যাত্রীসেবার মান বাড়ানোর চেষ্টা করছি। অনেক সময় যাত্রীসেবার মান আশানুরূপ থাকে না। আমরা এসব ঘাটতি পূরণে কাজ করছি। এজন্য কর্মীদের ট্রেনিং, মোটিভেশনে জোর দিচ্ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, ইউরোপিয়ান সেফটি অথরিটি আমাদের অডিট করে সনদ দিয়েছে। আমরা নিরাপত্তাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিই। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস স্বনামধন্য সংস্থার মানদন্ডে উত্তীর্ণ হয়েছে। কিন্তু আমাদের প্রচারের অভাবে ব্র্যান্ডিং হয়নি। এগুলো কম এয়ারলাইনসেরই আছে। জাতীয় বিমান সংস্থা হিসেবে আমাদের অনেক দায়বদ্ধতা আছে। সুদানে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের আমরা জেদ্দা থেকে দেশে ফিরিয়ে আনলাম। তুরস্কে ভূমিকম্পে আমরা চিকিৎসাসামগ্রী, ত্রাণ এবং চিকিৎসকদের নিয়ে গেছি। কভিড-১৯ মহামারিতে নিয়মিত টিকা বহন করে নিয়ে আসতে বিমান কাজ করেছে। চীন থেকে শিক্ষার্থীদের নিয়ে এসেছি। এ ছাড়া কূটনৈতিক কাজে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যাওয়া শান্তিরক্ষীদের আমরা পৌঁছে দিই। বিমান গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের পাশাপাশি বেশ কিছু এয়ারলাইনসকে বিভিন্ন সেবা দেয়। বিএফসিসি ক্যান্টিন থেকে বেশ কিছু এয়ারলাইনসে খাবার সরবরাহ করা হয়। সাভারে বিমানের পোলট্রি কমপ্লেক্স আছে ৭৬ একরের। এখান থেকে বিএফসিসি ক্যান্টিনে পোলট্রি সরবরাহ হয়। বিমানের নিজস্ব প্রেস আছে ফার্মগেটে।’

থার্ড টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। বিমানের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘থার্ড টার্মিনাল হলে আমাদের সুবিধা বাড়বে। বিমান গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে কাজ করে। আমাদের প্রায় ১ হাজার ৩০০ ছোটবড় যন্ত্রপাতি আছে। এখন জায়গাস্বল্পতার কারণে উড়োজাহাজ নামার পর ডাকলে কর্মীরা যন্ত্রপাতি নিয়ে যাচ্ছেন। এতে ১০ মিনিট লেগে যাচ্ছে। থার্ড টার্মিনাল চালু হলে আরও ভালো সার্ভিস দিতে পারব। এ কাজে ২৪ ঘণ্টায় আমাদের ৩ হাজার ৫০০ কর্মী কাজ করেন। বন্দর ব্যবস্থাপনা ভিন্ন বিষয়। আমাদের এখানে এটা সিভিল অ্যাভিয়েশন করে। কিন্তু এটা তাদের কাজ না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এটা অন্য প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয় এবং সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটি হিসেবে তদারকি করে। গ্রাউন্ড সার্ভিস এবং কার্গো সার্ভিস আলাদা বিষয়। আমাদের কয়েক হাজার কোটি টাকার ইকুইপমেন্ট আছে এসব কাজের জন্য। সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য আরও ১ হাজার কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনার পাইপলাইনে আছে। টেকনিক্যাল জায়গায় কেউ চাইলেই গিয়ে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং করতে পারবে না। এটা কেপিআইভুক্ত সেনসেটিভ জায়গা। চাইলেই এয়ারপোর্টের ভিতরে একটা প্রতিষ্ঠান ৩ হাজার ৫০০ কর্মী নিয়ে আসতে পারবে? এটা কি সম্ভব? কাতার, সিঙ্গাপুরসহ অন্য অনেক দেশে জাতীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইনসই গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ করে। হয়তো তাদের আলাদা একটা নাম থাকে, যেটা ওই প্রতিষ্ঠানের আওতায়।’

এয়ারপোর্টে যাত্রীরা অনেক সময় লাগেজ কাটা কিংবা চুরির অভিযোগ করেন। বিষয়টি কীভাবে মোকাবিলা করছেন- জিজ্ঞেস করলে শফিউল আজিম বলেন, ‘গত ছয় মাসে এরকম কোনো অভিযোগ আমার কাছে আসেনি। কারণ উড়োজাহাজ থেকে বেল্টে লাগেজ আসতে ১৮ মিনিটে লাগছে। উড়োজাহাজ নামার সঙ্গে সঙ্গে ট্রলি দিয়ে লাগেজ নামিয়ে বেল্টে নিয়ে চলে আসি, মাঝে কিন্তু কোনো ধাপ নেই। পুরোটা সিসি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রিত। ২৪ ঘণ্টা অনুসরণ করা হচ্ছে। মেয়েরা যখন সাফ ফুটবলে বিজয়ী হয়ে এলো, তখন এয়ারপোর্টে তাদের কিছু জিনিস হারানোর কথা উঠেছিল। তখন তদন্ত করে দেখা গেছে বিমানবন্দরে নয়, ঘটনা ঘটেছে ফুটবল ফেডারেশন ভবনে। লাগেজটা আরও ভালোভাবে হ্যান্ডলিং করতে কিছু যন্ত্রপাতি প্রয়োজন রয়েছে। থার্ড টার্মিনাল হলে আমরা এ সুবিধাটা পাব। অনেকে কাজ পাওয়ার জন্য নানা কথা বলে। কারণ এয়ারলাইনসের আয়ের বড় উৎস গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং। মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত রয়েছে বিমান গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং করবে। সে নিয়মেই বিমান এ কাজ করে আসছে।’

সরকারি প্রতিষ্ঠানের লোকসানে থাকার উদাহরণ দেশে অনেক রয়েছে। বিমানের আর্থিক পরিস্থিতি এখন কেমন? এ বিষয়ে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ১০ বছর ধরে লাভে আছে। অনেকে জানতে চায় জ্বালানি এবং সিভিল অ্যাভিয়েশনের অর্থ পরিশোধের পরে লাভে কি না? এটা তো একটা চলমান প্রক্রিয়া। তাদের অর্থ নিয়মমাফিক পরিশোধ করা হয়। বিমানও তো ডাকবিভাগ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে অর্থ পায়। তারা এগুলো সময়মতো নিশ্চয়ই পরিশোধ করবে। আমরা তো এটা বলে বেড়াই না। সমালোচনা অবশ্যই যৌক্তিক হওয়া উচিত। তাহলে আমরা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান সেগুলো আমলে নিয়ে সেবার মান বাড়াতে উদ্যোগ নিতে পারি।’

সর্বশেষ খবর