ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আয়তন ৩০৫ দশমিক ৪৭ বর্গকিলোমিটার। সবশেষ বিবিএস তথ্য অনুযায়ী সিটি করপোরেশন এলাকায় বসবাস করে ১ কোটি ২ লাখ ৭৯ হাজার ৮৮২ জন। জীবিকার তাগিদে এসব মানুষ ঢাকায় আসলেও মশা, ভাঙা সড়ক, জলাবদ্ধতা, বায়ুদূষণসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত। সিটি করপোরেশনের মেয়ররা সব ধরনের সেবা দেওয়ার অঙ্গীকার নির্বাচনের সময় দিলেও বাস্তবে স্মৃতি হয়ে যায় এসব প্রতিশ্রুতি। পক্ষান্তরে নাগরিক দুর্ভোগ না কমালেও তিন বছরে ঢাকার দুই মেয়র কর খাত বৃদ্ধি করেছেন অন্তত ২৮টি।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন তিন বছরে ১৯টি কর খাত বাড়িয়েছে। এর মধ্যে রিকশা লাইসেন্স ফি, ইমারত নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণের জন্য আবেদনের ওপর, নগরীতে ভোগ, ব্যবহার বা বিক্রয়ের জন্য পণ্য আমদানির ওপর। নগর থেকে পণ্য রপ্তানির ওপর, টোল জাতীয় কর, পেশা বা বৃত্তির ওপর। বিবাহ, তালাক, দত্তক নেওয়া ও জিয়াফত বা ভোজের ওপর কর। পশুর ওপর, জনসেবামূলক কার্যসম্পাদনের ওপর। সরকার আরোপিত করের ওপর। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ট্রেনিং সেন্টার প্রভৃতির ওপর এবং মেলা, কৃষি প্রদর্শনী, শিল্প প্রদর্শনী, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও অন্যান্য জনসমাবেশের ওপর কর নির্ধারণ করেছে সিটি করপোরেশন। এ ছাড়া বাজারের ওপর ফি (ইজারা), টিউটোরিয়াল স্কুল, কোচিং সেন্টার ইত্যাদি নিবন্ধিকরণ ফি, প্রাইভেট হাসপাতাল, প্যারামেডিকেল ইনস্টিটিউট, ক্লিনিক, ডায়াগনোস্টিক সেন্টার ইত্যাদির নিবন্ধিকরণ ফি, করপোরেশন এলাকায় অবস্থিত হোটেলে অবস্থানকারীর ওপর নগর কর, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কাজে নিযুক্ত প্রাইমারি কালেকশন সার্ভিস প্রোভাইডার (পিসিএসপি) নিবন্ধন ও বাৎসরিক ফি, ইউটিলিটি সার্ভিস প্রদানে রাস্তা ব্যবহার ফি ও অন্যান্য (ব্যাংক সুদ, মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু) খাত রাখা হয়েছে। এর বেশির ভাগ খাত থেকে টাকা আদায় করছে সংস্থাটি।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন তিন বছরে ৯টি কর খাত বাড়িয়েছে। এর মধ্যে মোবাইল টাওয়ার, ইমারত নির্মাণ এবং পুনর্নির্মাণের জন্য আবেদনের ওপর কর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ট্রেনিং সেন্টার প্রভৃতির ওপর। মেলা ও বাণিজ্যিক প্রদর্শনীর ওপর ফিস, টিউটোরিয়াল স্কুল, কোচিং সেন্টার ইত্যাদির ওপর, বাজারের ওপর ফি, এয়ারপোর্ট এবং রেলস্টেশন থেকে কর, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন থেকে কর এবং স্মার্ট পার্কিং থেকে কর আদায় করছে সংস্থাটি।করখাত বৃদ্ধি করলেও নাগরিক সেবা বাড়াতে পারেনি সংস্থা দুটি। এর মধ্যে জলাবদ্ধতা সমস্যা বহু পুরনো। এ সমস্যা নিরসনে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিলেও কোনো সমাধান হচ্ছে না। একটু বৃষ্টি হলেই দুই সিটির অধিকাংশ স্থানে এখনো জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। একই সঙ্গে চলছে এডিস মশার রাজত্ব। প্রতিদিনই ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছেন কয়েক শ নাগরিক। হচ্ছে প্রাণহানিও। সিটি করপোরেশনের মশককর্মীরা ঠিকমতো ওষুধ স্প্রে করছে না বলে অভিযোগ নাগরিকদের। যদিও সিটি করপোরেশনের দাবি, মশককর্মীরা নিয়মিত ওষুধ স্প্রে করছে। একই অবস্থা দূষণেও। শব্দ ও বায়ুদূষণে শীর্ষে অবস্থান করছে রাজধানী। ২৭ মার্চ শব্দদূষণে শীর্ষে ছিল ঢাকা। বায়ুদূষণেও মাঝে মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করতে দেখা যায়। এসব সমস্যা লাঘবে সিটি করপোরেশনের দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম দেখা যায় না। বেহাল অবস্থায় রাজধানীর গণপরিবহন ব্যবস্থাও। লক্কড়ঝক্কড় বাস, যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, অদক্ষ চালকসহ নানা সমস্যায় রাজধানীর বাস সার্ভিস। এসব নিয়ন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটিও করে দিয়েছেন। এ কমিটি ২৭টি সভা করেছে। তিনটি রুটে ঢাকা নগর পরিবহন চালু করেছে। যদিও এ তিন রুটে পরিবহন চলছে বিশৃঙ্খলা অবস্থায়। যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ি, যানজট, ফুটপাত, পার্ক ও মাঠ অবরুদ্ধ, ফুটপাত সংকট, অলিগলিতে বাজার, ভাঙাচোরা সড়কসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত সিটির বাসিন্দারা। ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাজধানী ঢাকা অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। একই সঙ্গে খাল, নদী, জলাশয় দখল করে বড় বড় ভবন গড়ে উঠেছে। এখন চাইলেই তাৎক্ষণিক কোনো সমাধান সম্ভব নয়। তবে পরিকল্পিত উপায়ে একটা একটা খাত ধরে এগোলে সমাধান সম্ভব। এ ক্ষেত্রে বড় বড় প্রকল্প নিয়ে বেশি অর্থ ইনভেস্ট করলে হবে না। পরিকল্পনা নিয়ে অল্প খরচে বেশি সমাধান- এ রকম উপায় বের করে উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে। তিনি বলেন, বাসযোগ্য শহরে ফিরতে হলে ছোট ছোট কিছু উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে হবে। মেয়ররা চাইলেও খেলার মাঠ বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে করপোরেশনের আওতায় থাকা খেলার মাঠ ও পার্কগুলো সংস্কার করে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। এভাবে পরিচ্ছন্ন শহর গড়াও সম্ভব। অবৈধ পার্কিং, বর্জ্য অপসারণসহ অনেক উদ্যোগকে সফল করতে কমিউনিটির সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। নাগরিকরা সম্পৃক্ত হলে ছোট ছোট উদ্যোগ বাস্তবায়ন সম্ভব। বড় বড় প্রকল্পের পেছনে না ঘুরে জনসম্পৃক্ত কাজ বাস্তবায়নে সিটি করপোরেশনের প্রতি তাগিদ দেন এই নগর বিশেষজ্ঞ। ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস এ বিষয়ে সম্প্রতি বলেন, জলাবদ্ধতামুক্ত রাখতে বিভিন্ন স্থানে অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন করা হয়েছে। একই সঙ্গে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় প্রতিটি ওয়ার্ডে সেকেন্ডারি ট্রান্সপার স্টেশন (এসটিএস) নির্মাণপ্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। খাল সংস্কারে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে ঐতিহ্য, সুন্দর, সচল, সুশাসিত ও উন্নত ঢাকা গড়ে তোলার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।