সীমান্তের ওপারে সারি সারি পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে খেলা করছে সফেদ মেঘমালা। আর পাহাড়ের বুক চিরে নেমে এসেছে স্বচ্ছ জলরাশি। চকচকে সাদা পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলা স্রোতস্বিনী নদীটির নাম ধলাই। সিলেটের উত্তর সীমান্তঘেঁষা কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এই নাম ধারণ করেছে নদীটি। বাংলাদেশের উৎসমুখ ভোলাগঞ্জে নদীটির অপরূপে মুগ্ধ হন পর্যটকরা। সাদা পাথরের ওপর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলা স্রোতস্বিনী নদীতে অবগাহনের জন্য প্রতিদিন ছুটে যান হাজারও পর্যটক। ভালোবেসে পর্যটকরা নিজেরাই উৎসমুখের নামকরণ করেছেন ‘সাদা পাথর’। এই ‘সাদা পাথর’ পর্যটন কেন্দ্রই এখন সিলেটে বেড়াতে আসা পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণে পরিণত হয়েছে। পর্যটন ঘিরে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে স্থানীয় অর্থনীতিতেও।
সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলা কোম্পানীগঞ্জ। উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ধলাই নদী। একসময় এই নদী ছিল পাথরের জন্য দেশখ্যাত। প্রতিদিন হাজার হাজার ঘনফুট পাথর উত্তোলন হতো নদীটির ভোলাগঞ্জ অংশ থেকে। অপরিকল্পিতভাবে নদী খনন ও পরিবেশ ধ্বংসের অভিযোগে বর্তমানে বন্ধ রয়েছে পাথর উত্তোলন। নদীটির উৎসমুখ (বাংলাদেশে প্রবেশমুখ) একসময় স্থানীয়দের কাছে ১০ নম্বর ঘাট হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রায় এক দশক ধরে ধলাই নদীর উৎসমুখের সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশের পর্যটকদের কাছে। এর মধ্যে পাথর উত্তোলন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উৎসমুখের সৌন্দর্য আরও বেড়ে যায়। সাদা রঙের পাথরের ওপর দিয়ে নদীর স্বচ্ছ জলের স্রোতের অপরূপ সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে পর্যটকরাই ওই স্থানের নামকরণ করেন ‘সাদা পাথর’। সাদা পাথরের ওপারে ভারতের মেঘালয় রাজ্য। সীমান্তঘেঁষা সারি সারি পাহাড় বেয়ে নেমে এসেছে জলরাশি। পাথুরে নদীর ওপর দিয়ে এই জলরাশি ছুটে চলছে অবিরত। স্বচ্ছ পানি, স্রোত আর ছোট ছোট ঢেউ মিলে সাদা পাথরে তৈরি হয় মোহনীয় দৃশ্য।
সঙ্গে যুক্ত হয় ওপারের মেঘঢাকা পাহাড়ের সৌন্দর্য। যোগাযোগব্যবস্থা ভালো হওয়ায় এখন সিলেটের প্রধান আকর্ষণে পরিণত হয়েছে সাদা পাথর। সিলেটে বেড়াতে আসা পর্যটকরা প্রথমেই ছুটে যান সেখানে। এরপর ঘুরে দেখেন অন্য পর্যটন কেন্দ্রগুলো। সাদা পাথর পর্যটন কেন্দ্রে যাওয়ার পথে পর্যটকরা ঢুঁ মারার সুযোগ পান স্তরে স্তরে সাজানো চা-বাগান ও সবুজ গ্যালারির ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। যাওয়ার পথে উঁচু-নিচু টিলা, ক্যাডেট কলেজ, পর্যটন মোটেল ও আইসিটি পার্ক মন জুড়ায় পর্যটকদের। যোগাযোগব্যবস্থা ভালো হওয়ায় সিলেট শহর থেকে প্রাইভেট গাড়িতে ভোলাগঞ্জ যেতে সময় লাগে মাত্র ৪৫ মিনিট। এরপর নৌকা নিয়ে যেতে হয় সাদা পাথর পর্যটন কেন্দ্রে। প্রতিটি নৌকায় মাঝিরা তোলেন আটজন যাত্রী। যাওয়া ও আসার ভাড়া হিসেবে নেন জনপ্রতি ১০০ টাকা। সকালে বের হলে সাদা পাথর ঘুরে পর্যটকরা বিকালে যেতে পারেন গোয়াইনঘাট উপজেলায় অবস্থিত দেশের একমাত্র সোয়াম্প ফরেস্ট রাতারগুল। রাতারগুল দর্শন শেষে সন্ধ্যায় আবার ফেরা যায় শহরে। তাই পর্যটকরা তাদের বেড়ানোর তালিকার শীর্ষে রেখেছেন সাদা পাথর। নরসিংদীর পলাশ উপজেলা থেকে সপরিবার সাদা পাথর বেড়াতে এসেছেন ব্যাংকার মাহমুদুল হাসান। সাদা পাথরের সৌন্দর্যে মুগ্ধ মাহমুদুল বলেন, ‘সিলেটে এর আগেও কয়েকবার এসেছি। সিলেট এলেই প্রতিবার জাফলং যেতাম। কিন্তু এবার প্রথম সাদা পাথর এসেছি। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে অন্য কোনো স্থানের তুলনা হয় না। স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে অন্তত তিন ঘণ্টা নদীতে ছিলাম। বাচ্চারা তো পানি থেকে উঠতেই চাইছিল না। এখন থেকে সিলেট এলেই আগে সাদা পাথর বেড়াতে যাব।’