মঙ্গলবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

বেহাল ইন্টারনেট, দাম বেশি গতি কম

♦ মোবাইলের গতিতে অবস্থান ১১৮, ব্রডব্যান্ডে ১০৪ ♦ দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে দাম বেশি

জিন্নাতুন নূর

বেহাল ইন্টারনেট, দাম বেশি গতি কম

বর্তমান আধুনিক সময়ে এসে দৈনন্দিন জীবনযাপনকে অনেকটাই সহজ করে তুলেছে ইন্টারনেটের ব্যবহার। ইন্টারনেট ছাড়া এখন মানুষ এক মুহুূর্তও আর চিন্তা করতে পারে না। ক্রমেই দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১৩ কোটি মানুষ ইন্টারনেট সেবা নিচ্ছেন। কিন্তু চাহিদা বাড়লেও ব্যবহারকারীরা ইন্টারনেটের সেবা নিয়ে সন্তুষ্ট নন। নেটওয়ার্ক না থাকা, কম গতিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে গ্রাহকের। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অভিযোগ ইন্টারনেট প্যাকেজের অতিরিক্ত দাম নিয়ে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ছাড়া দেশব্যাপী নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) আইসিটি জরিপের ফলাফল অনুযায়ী বর্তমানে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন ৪৪ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ। যা ২০১৩ সালে ছিল মাত্র ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। এই হিসাবে ১০ বছরের ব্যবধানে ইন্টারনেটের ব্যবহার বেড়েছে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী প্রায় ৯০ শতাংশ। এর মধ্যে স্মার্টফোন ব্যবহার করেন ৬৩ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ। ইন্টারনেট ব্যবহারে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে ঢাকার মানুষ। এই বিভাগে ইন্টারনেট সেবা পাচ্ছেন ৫৯ শতাংশ মানুষ। আর ইন্টারনেট ব্যবহারে সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে আছে রংপুর বিভাগ। সেখানে ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। দেশের ইন্টারনেটের গতি নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তথ্যে দেখা যায়, ইন্টারনেটের গতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান খুব বেশি সন্তোষজনক নয়। ইন্টারনেট গতি মাপার আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ওকলা জানায়, বিশ্বের ১৪৫টি দেশের মধ্যে মোবাইল ইন্টারনেটের গতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৮তম। আর ফিক্সড ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের গতিতে ১৮২টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৪তম। স্পিডটেস্ট গ্লোবাল ইনডেক্স নামের এই প্রতিবেদন গত আগস্ট মাসে প্রকাশিত হয়। আবার বাংলাদেশে ইন্টারনেটের দাম দক্ষিণ এশিয়ার অন্য সব দেশের চেয়ে বেশি। ইন্টারনেটের দাম ও মান পর্যালোচনাকারী ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান কেবল ডটকো ডট ইউকে জানায়, দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম দামে ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছে ভারত। এক গিগাবাইট ইন্টারনেটের দাম ভারতে ১৭ মার্কিন সেন্ট। আর নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় ২৭ মার্কিন সেন্ট। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের গ্রাহকরা খরচ করছেন ৩২ সেন্ট। একইভাবে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের দামও অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বেশি। ইন্টারনেটের ব্যবহারকারীদের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়েও রয়েছে অস্বস্তি ও নানা অভিযোগ। ইন্টারনেট ব্যবহারের হার বৃদ্ধি পেলেও সেবার মান সেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা ও বড় শহরগুলোতে ইন্টারনেট সেবার মান নিয়ে গ্রাহকের অভিযোগের শেষ নেই। দেশের উপকূল, চরাঞ্চল ও পার্বত্য বিভিন্ন এলাকায় এখনো ইন্টারনেট সুবিধা সেভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। বিভিন্ন কোম্পানির মোবাইল ইন্টারনেট ও ফিক্সড ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের প্যাকেজের অতিরিক্ত দাম নিয়েও গ্রাহকের মধ্যে রয়েছে অসন্তুষ্টি।

গাইবান্ধার পলাশবাড়ীর অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আবদুল সোহরাব। তার একমাত্র ছেলে মো. রাসেল স্ত্রীসহ দুই সন্তানকে নিয়ে গত চার বছর পর্তুগালে থাকছেন। হোয়াটসঅ্যাপের ভিডিও কলে প্রতিদিনই রাসেল গাইবান্ধায় থাকা মা-বাবার সঙ্গে কথা বলেন। ছেলের সঙ্গে কথা বলার জন্য সোহরাব প্রতি মাসেই মোবাইল ইন্টারনেটের প্যাকেজ কেনেন। কিন্তু তার বাড়িতে নেটওয়ার্ক খুব একটা ভালো নয়। এ জন্য একজনের পরামর্শে তিনি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের সংযোগ নিয়েছেন। কিন্তু এরপরও খুব একটা ভালো ইন্টারনেট সেবা পাচ্ছেন না। কথা হলে এই প্রতিবেদককে সোহরাব বলেন, ছেলে ও নাতনিদের সঙ্গে এই ইন্টারনেটেই যোগাযোগ আছে। কিন্তু কথা বলার সময় বারবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আবার ভিডিও কলে কথা বলার সময়ও বেশ সমস্যা হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, ন্যাশনাল টেকনিক্যাল ট্রান্সফার নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন)-এর মাধ্যমে দেশের দুর্গম এলাকায় ইন্টারনেট যাচ্ছে। দুর্গম এলাকায় মাটির নিচে যাওয়া কষ্টকর। এ জন্য ওপর দিয়ে ক্যাবল নিয়ে যেতে হয়। সেক্ষেত্রে অনেক সময় দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় ক্যাবল কাটা পড়লে তা ঠিক করতে অনেক সময় লেগে যায়। সেক্ষেত্রে এসব এলাকায় নির্বিঘ্ন ইন্টারনেট সেবা পাওয়া যায় না। ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) প্রেসিডেন্ট মো. এমদাদুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের এখানে একটি রাউটার (১০ এমবিপিএস) ব্যবহার করার কথা দুজনের। কিন্তু দেখা যাচ্ছে একটি পরিবারের ছয় থেকে সাতজন সদস্য সেই রাউটার ব্যবহার করছেন। তখন ইন্টারনেটের গতি কমে যায়। গ্রাহকরা ভাবছেন ৫০০ টাকার ইন্টারনেট প্যাকেজে তার মাসে হয়ে যাবে কিন্তু তারা যদি নিজেদের ব্যবহার অনুযায়ী প্যাকেজ বেছে নেন তাহলে ইন্টারনেটের গতিতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তিনি আরও বলেন, সরকারি পর্যায় ছাড়াও ব্যক্তিগত পর্যায়ে আইএসপিএবি-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো দেশে ইন্টারনেট প্রসারের জন্য কাজ করছে। থানা পর্যায়ের ইন্টারনেট প্রোভাইডাররা এখন প্রত্যন্ত এলাকায় যাচ্ছেন। যেসব এলাকায় পল্লী বিদ্যুৎ ও পিডিবির পোল নেই সেখানে ব্রডব্যান্ড সংযোগ দিতে সমস্যা হচ্ছে। এসব এলাকায় ইন্টারনেটের সুবিধা বাড়াতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে হবে। আবার কিছু এলাকায় চাহিদা না থাকায় সেখানেও ইন্টারনেটের প্রসার সেভাবে হয়নি। বেসরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণের কারণে দেশের গ্রাম পর্যায়ে ইন্টারনেটের প্রসার হয়েছে।

সর্বশেষ খবর