শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সবচেয়ে কঠিন সময় পাড় করছে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়। পালাবদলের ঢেউ লেগেছে প্রশাসনে। এতে করে রাতারাতি সবাই এখন আওয়ামীবিরোধী হয়ে গেছেন। তবে চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ ও ক্ষমতা দেখানো শীর্ষ কর্মকর্তারা পড়েছেন বেকায়দায়। ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে যারা রাজত্ব করেছেন প্রশাসনে, তারা এখন সবচেয়ে বেশি বেকায়দায়। অনেক সচিব, অতিরিক্ত সচিব এমনকি ক্ষমতা দেখানো উপসচিব, সচিব মন্ত্রীদের পিএস এখন অফিস ছাড়া। কেউ কেউ আত্মগোপন করেছেন। তবে এরই মধ্যে সক্রিয় হয়ে সংঘবদ্ধ হচ্ছেন বঞ্চিত কর্মকর্তারা। সচিবালয় ঘুরে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
এরই মধ্যে পুলিশ প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে। দ্রুত প্রশাসনেও বড় সংস্কার আসবে মনে করছেন অনেকে। এ জন্য যারা বেশি দলবাজখ্যাত কর্মকর্তা বা আগের সরকারের ঘনিষ্ঠ- তারা ভিতরে ভিতরে নানা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। গত সোমবার ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকে বিভিন্ন কর্মকর্তার খোঁজ মিলছে না। অনেকেই ফোন ধরছেন না, কেউ কেউ আত্মগোপনে চলে গেছেন। সরকারের পদত্যাগের পর বিভিন্ন স্থানে হামলা জ্বালাও পোড়াও হয়েছে। এরপর দুই দিনে সাধারণ কর্মকর্তা কর্মচারীরা অফিসে এলেও অনেক মন্ত্রণালয়ের সচিব, অতিরিক্ত সচিব অফিস করেননি। এরই মধ্যে কয়েকটি অধিদপ্তরে কর্মকর্তাদের কর্মচারীরা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছেন। এসব খবর ছড়ানোর পর ভয়ে আছেন অনেকে। বিশেষ করে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের অনেকেই মোবাইল বন্ধ রেখেছেন। সরকারের ৮৫ জন সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার মধ্যে গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে ১০-১২ জন অফিস করেছেন। গতকাল অফিস করেছেন সর্বোচ্চ ১৫ জন। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোস্তফা কামাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমি পুরো সময় অফিস করেছি। আমার মতো অনেকেই করছেন। এটা ঠিক পরিস্থিতির কারণে কেউ কেউ হয়তো করছেন না। তবে আমি মনে করি আমরা যারা সরকারে কাজ করি সবাই পেশাদার। আইনের মধ্যে থেকে কাজ করি। এই পরিস্থিতির মধ্যে আমাকে নিয়মিত বন্দরগুলো ঠিক রাখতে যোগাযোগ করতে হয়েছে। কেউ কেউ বলেন, এই সচিব, ওই সচিব। মনে কোনো ভয় না থাকলে তিনি পালাবেন কেন? খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত সোমবার পর্যন্ত আওয়ামীপন্থি হিসেবে পরিচিত কর্মকর্তা কর্মচারীদের অনেকেই রাতারাতি জামায়াত বা বিএনপি হয়ে গেছেন। কেউ কেউ নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছেন। এরই মধ্যে সচিবালয়ে নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে মঙ্গলবার বচসা ও হাতাহাতি হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের বাইরে কয়েকটি অধিদপ্তরে নানাভাবে লাঞ্ছনার খবরও পাওয়া গেছে। এতে করে অধিদপ্তরগুলোতে দায়িত্ব পালন করা অনেকেই অফিস করছেন না। সবাই অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হলে অফিস শুরু করবেন বলে জানা গেছে।
সচিবালয়ে জনপ্রশাসন সচিবের রুম ঘেরাও : সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরীর কার্যালয় ঘেরাও করে রেখেছিল পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। জানা গেছে, সকাল থেকে সচিবালয়ে কর্মচারীরা আসার পর দুপুর ১২টার দিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের লাইব্রেরিতে একত্রিত হন পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মচারীরা। তারা জরুরি আলোচনা করে তৈরি করেন বঞ্চিতদের তালিকা। পরে এ তালিকা নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) রিপন চাকমার দপ্তরে যান। তাকে না পেয়ে ‘ভুয়া ভুয়া’ বলে স্লোগান দেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সিনিয়র সচিব সে সময় অফিসে ছিলেন না। পরে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন সচিব বলেন, আমি সচিবালয়ে আসছি পরে। এসব বিষয় আমরা দেখব। পদোন্নতি দিতে গেলে এসএসবি সিদ্ধান্ত লাগে, সেটা যাতে দ্রুত হয় সে উদ্যোগ নেব।বঞ্চিত কর্মকর্তারা সোচ্চার : এদিকে সচিবালয়ে নিজেদের পদোন্নতি ও বঞ্চনার অবসান দূর করতে সোচ্চার হয়েছেন দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। গত দুই দিন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে শত শত কর্মকর্তা আসছেন। নিজেদের তালিকা করছেন। গত ১৬ বছরের শাসনামলে পদোন্নতিবঞ্চিত একজোট হয়ে নিজেদের নানা কথা শেয়ার করছেন। অনেক কর্মকর্তা আছেন, যিনি গত দেড় দশকে একটি পদোন্নতিও পাননি। অথচ তারই ব্যাচমেট যুগ্মসচিব বা অতিরিক্ত সচিব হয়ে গেছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের লাইব্রেরিতে এসব বিএনপি-জামায়াতপন্থিসহ বিভিন্ন বঞ্চিত কর্মকর্তা নিয়মিত বৈঠক করছেন।
গতকাল সচিবালয়ে দেখা গেছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রীর রুমেই বৈঠক করছেন অনেকেই। প্রশাসনের ক্যাডার ও নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দীর্ঘদিনের বঞ্ছনার হিসেব কড়ায়-গন্ডায় আদায়ের ঘোষণাও দিয়েছেন। সচিবালয়ে কর্মরত প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের পদনাম পরিবর্তন, পেশাগত ও বেতন বৈষম্য দূরীকরণ, বেতন কমিশন গঠনসহ দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ও হতাশা নিরসনের জন্য আবেদন জানিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী নেতারা। গতকাল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাউদ্দিন চৌধুরীর কাছে এসব দাবি সংবলিত স্মারকলিপি দেন বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. নজরুল ইসলাম। তিনি জানান, সরকারি চাকরিতে নিজেদের বিকশিত করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবর উপস্থাপন করা হলেও আজও কোনো দাবি বাস্তবায়ন করা হয়নি। উচ্চতর পদ সৃষ্টি, পদ সংরক্ষণ, পদোন্নতির ক্ষেত্রে অহেতুক জটিলতা সৃষ্টি, টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড সংকুচিতকরণ, ৫০ শতাংশ পেনশন প্রদান, বাস্তবতার আলোকে পদনাম পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয়ে কর্মচারীদের মাঝে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। শুধু তাই নয়, জাতীয় পে-কমিশন, ২০১৫ ঘোষিত হওয়ার পর আজ অবধি বেতন কমিশন গঠন করা হয়নি। বিগত ১৫-১৬ বছর ধরে কর্মচারীদের পেশাগত দাবি-দাওয়া বাস্তবায়ন না হওয়ায় কর্মচারীরা প্রশাসনিক, পারিবারিক ও সামাজিক বৈষম্যের সম্মুখীন হয়েছেন উল্লেখ করে তারা অবিলম্বে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার জন্য নয় দফা দাবি সিনিয়র সচিবের কাছে দাখিল করেন।
দাবিসমূহের মধ্যে রয়েছে- ১) সচিবালয়ে কর্মরত নন-ক্যাডারের ৩৭০টি পদসহ প্রতিটি পদের এক তৃতীয়াংশ পদ সংরক্ষণ। ২) প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তাগণের পদবি উপসহকারী সচিব নামকরণ। ৩) গ্রেড ১১-১৬ এর কর্মচারীদের চারটি পদকে অতিরিক্ত উপসহকারী সচিব। ৪) গ্রেড ১৭-২০ গ্রেডের চারটি পদকে সচিবালয় সহকারী হিসেবে নামকরণ। ৫) নবম জাতীয় পে-কমিশন গঠন, পূর্বের ন্যায় টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহাল। ৬) রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ন্যায় সচিবালয়ে সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবিলম্বে ২০ শতাংশ টিপটপ ভাতা প্রদান। ৭) শতভাগ পেনশন অবিলম্বে পুনর্বহাল। ৮) পেনশন গ্র্যাচুইটির হার ১:৫০০ টাকা অবিলম্বে নির্ধারণ এবং ৯) সচিবালয়ে সব শ্রেণির ব্লকড পদ বিলুপ্ত করে সমপদনাম বা মর্যাদা ও বেতন গ্রেডের পদে অন্তর্ভুক্তির আবেদন জানানো হয়েছে।
সচিবদের পদত্যাগের প্রস্তুতি : এদিকে, কয়েকজন সচিব পদত্যাগ করছেন বলে গতকাল সচিবালয়ে রব ওঠে। তবে বিকালে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাউদ্দিন চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমি এখন পর্যন্ত কোনো সচিবের পদত্যাগের চিঠি পাইনি। তবে প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তা জানান, যারা এরই মধ্যে চুক্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন তারা বেশি আতঙ্কে আছেন। তাদের চুক্তি দ্রুতই বাতিল করা হবে সে আশঙ্কায় আছেন অনেকে। তবে সেটি অন্তর্বর্তী সরকারই বাতিল করবে নাকি এর পর নতুন সরকার বাতিল করবে সে বিষয়ে অনেকেই ধোঁয়াশায় আছেন। কয়েকজন সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করলে একজন বলেন, পদত্যাগ করিনি তবে করব এমন প্রস্তুতি আছে। প্রত্যেকেই তার টিমটা নিজের মতো সাজাতে চায়। আরেকজন সচিব বলেন, সামনে যারাই দায়িত্ব নেবেন তাদের থেকে একটি প্রস্তাবনা থাকবে সে অনুযায়ী প্রস্তুতি আছে। আপাদত অফিস করছি না। একজন সিনিয়র সচিব বলেন, আমরা অনেকেই চুক্তিতে কেউ নিয়মিত। দীর্ঘদিন একটি সরকারের হয়ে কাজ করেছি এখন সে কারণে আমাদের দিকে নজর দেওয়া স্বাভাবিক তবে যে সিদ্ধান্তই আসুক সে ধরনের প্রস্তুতি রাখি। দেশের জন্য কাজ করাই সবার লক্ষ্য, সামনে যে দায়িত্বে আসবে সেও সরকারের নির্দেশনাই মানবে এটাই স্বাভাবিক। এদিকে গত দুই দিন ধরে বঞ্চিত কর্মকর্তারা দাবি তুলেছেন সব পর্যায়ের চুক্তি নিয়োগ বাতিল করে দক্ষ যোগ্য কর্মকর্তাদের সুযোগ দিতে হবে।