শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নানা রকম দাবিদাওয়ার আন্দোলনে অচল হয়ে পড়েছে স্বাস্থ্য খাত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) অপসারণ, চিকিৎসকদের নিরাপত্তা, নার্স, নার্সিং শিক্ষার্থী, ফিজিওথেরাপি শিক্ষার্থীরা প্রায় দিনই বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন করছেন। এতে বিঘ্ন হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা, ভোগান্তিতে পড়েছেন রোগীরা।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালালে সব রকম খাত সংস্কার নিয়ে শুরু হয় আলোচনা। সংস্কারের হাওয়া স্বাস্থ্য খাতে লাগলে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দায়িত্ব পালন করা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, অতিরিক্ত মহাপরিচালক, ডিরেক্টর, লাইন ডিরেক্টরসহ পদস্থ কর্মকর্তাদের অপসারণের দাবি উঠতে থাকে। গত ১৩ আগস্ট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ অধিদপ্তরের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের অপসারণ এবং অবৈধ নিয়োগ, পদোন্নতি বন্ধের দাবিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ঘেরাও করেন স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা। এর মধ্যেই পদত্যাগ করেন তৎকালীন মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম।
এরপর গত ১৮ আগস্ট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক মোহাম্মদ রোবেদ আমিনকে ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালকের দায়িত্ব দিয়ে প্রজ্ঞাপন করা হয়। এতে ফুঁসে ওঠেন বৈষম্যের শিকার চিকিৎসক, বিএনপি পন্থি চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) সদস্যরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ঘেরাওসহ নানামুখী কর্মসূচি দেন তারা। আন্দোলনের মুখে অচল হয়ে পড়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। নিয়োগ পেলেও অধিদপ্তরে প্রবেশ করতে পারেননি রোবেদ আমিন। এ সমস্যা সমাধানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন স্বাস্থ্য উপদেষ্ট নূরজাহান বেগম। কিন্তু তাতেও মেলেনি সমাধান। অবশেষে আন্দোলনকারীদের দাবির মুখে গত ১২ সেপ্টেম্বর রোবেদ আমিনকে সরিয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল হোসেনকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই চলমান আন্দোলনের মধ্যেই ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসকের ওপর হামলার ঘটনায় বিক্ষোভে ফেটে পড়েন সারা দেশের চিকিৎসক সমাজ। চিকিৎসকদের নিরাপত্তা দাবিতে কমপ্লিট শাটডাউনের ঘোষণা আসে। পরবর্তীতে জরুরি সেবা চালু রেখে ইনডোর-আউটডোরে সেবা দেওয়া বন্ধ করে দেন চিকিৎসকরা। তিন দিনের এ আন্দোলনে সেবা পেতে সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হয় রোগীদের।পরবর্তীতে কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ বেশ কিছু শর্ত পূরণে কর্তৃপক্ষ রাজি হলে পুরোদমে সেবা চালু করেন চিকিৎসকরা। এ রেশ না কাটতেই আন্দোলনে নেমে পড়েছেন নার্সরা। নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মাকসুরা নুরের মন্তব্যকে ঘিরে আন্দোলনে নামেন ঢাকাসহ সারা দেশের হাসপাতালের কর্মরত নার্সরা। গতকাল ঢাকাসহ সারা দেশের হাসপাতালগুলোতে নার্সদের মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় তারা মাকসুরা নুরের পদত্যাগ দাবি করেন। তাদের দাবি মানা না হলে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দেন তারা। নার্সদের দাবির মধ্যে রয়েছে- নার্সিং অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, পরিচালক এবং নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ও রেজিস্ট্রার পদে উচ্চশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ নার্সদের নিয়োগ দিতে হবে।
আন্দোলনকারী নার্সরা জানান, অতীতে এই দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হলেও ১২ সেপ্টেম্বর পুনরায় একজন নন-নার্স প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে রেজিস্ট্রার পদে পদায়ন করা হয়েছে, এতে নার্সদের ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। নার্সদের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, আজ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। প্রয়োজনে তারা কর্মবিরতির মতো কঠোর পদক্ষেপ নিতেও প্রস্তুত।
নার্সরা অভিযোগ করে বলেন, গত ৮ সেপ্টেম্বর মাকসুরা নুর নার্সদের পেশাকে হেয় করে বক্তব্য দেন। সেখানে তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া নার্সদের দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা প্রদানকে ?‘ভুল’ বলে উল্লেখ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে নার্স-সমাজ ক্ষুব্ধ হয়, যা গত ৯ সেপ্টেম্বর থেকে আন্দোলনে রূপ নেয়। গতকাল শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, সকাল থেকে আউটডোর-ইনডোরে রোগীর ভিড়। কিন্তু নার্স না থাকায় সেবা পাচ্ছেন না তারা। পায়ে গরম পানি পড়ে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন কেরানীগঞ্জের মোকাব্বির হোসেন। তিনি বলেন, ‘পায়ে ড্রেসিং করানোর জন্য আসতে বলেছিলেন চিকিৎসকরা। কিন্তু নার্স না থাকায় রোগীরা সেবা পাচ্ছেন না। নার্সরা আন্দোলনে যাওয়ায় এ সংকট তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া সরকারি চাকরিতে নিয়োগ এবং সরকারি ফিজিওথেরাপি কলেজ প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন করছেন বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ফিজিওথেরাপির শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন স্তরের স্বাস্থ্যকর্মীদের আন্দোলনে টালমাটাল হয়ে পড়েছে দেশের স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতি।