অবাক করা কৌশলে পাচার হচ্ছে ইয়াবা ও আইস। চাল, কাঠ আর পিঁয়াজের ভিতরেও লুকিয়ে পাচার হচ্ছে প্রাণঘাতী নেশাজাতীয় দ্রব্য। বাদ যাচ্ছে না বাসের গিয়ারবক্স কিংবা মানুষের পেট। মিয়ানমার সীমান্ত থেকে আসা মাদক কারবারিরা নিত্যনতুন ফন্দি আঁটছেন এ অবৈধ কারবারে। ইয়াবার চালান দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দিতে মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার থেকে শুরু করে ট্রেন, বিমান ব্যবহৃত হচ্ছে। এমনকি জলপথও এ কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। আর এ কাজে জড়িত ২২ পেশার মানুষ। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তদন্তে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে।
সীমান্ত এলাকায় মাদক কারবার নিয়ে গবেষণাকারী, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চলের (উত্তর ও দক্ষিণ) উপপরিচালক হুমায়ন কবির খোন্দকার বলেন, ‘কিছুদিন আগে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চল মাদকের রুট ও পাচার পদ্ধতি নিয়ে একটি তদন্ত করে। তদন্তকালে দেখা গেছে, ৯টি পদ্ধতি অনুসরণ করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাচার হচ্ছে ইয়াবা ও আইস। কক্সবাজার থেকে বিভিন্ন জায়গায় মাদক ক্যারিয়ার হিসেবে কাজ করছে ২২ শ্রেণি-পেশার মানুষ। তদন্তের ফলাফল নিয়ে কাজ করছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।’ জানা যায়, বাংলাদেশে ইয়াবা এবং আইসের জোগান আসে মাদকের রাজধানী খ্যাত ‘সান স্টেট’ (যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা রাজ্য) থেকে। কুখ্যাত ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেলের মিয়ানমারের অংশের রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিত্তে এবং মংড়ু, রাথিডং, বুথিডংসহ বিভিন্ন টাউনশিপ হয়ে তা দেশে প্রবেশ করে। বাংলাদেশে ইয়াবা ও আইসের চালানের সিংহভাগই আসে বান্দরবান ও কক্সবাজারের মিয়ানমার সীমান্তবর্তী নাইক্ষ্যংছড়ি, টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলার পাহাড়, নাফ নদ ও বঙ্গোপসাগর হয়ে। দেশে আসার পর মাদকের চালান চলে যায় বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ে গড়ে ওঠা ট্রান্সন্যাশনাল চক্রগুলোর কাছে। মাদক পাচারের বেশ কিছু পদ্ধতি ও জড়িতদের তথ্য উঠেছে এসেছে সম্প্রতি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি তদন্তে। অধিদপ্তরের প্রতিবেদন বলছে, মোটরসাইকেলের মাধ্যমে এবং বাসের গিয়ারবক্স ও ইঞ্জিনের ভিতরে বিশেষ চেম্বার তৈরি করে ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্য লুকিয়ে বহন করা হয়। মিয়ানমার থেকে আমদানি করা মরিচ, চাল, ডাল, শুঁটকি, পিঁয়াজ এবং বাঁশের ভিতরে বড় বড় ইয়াবা-আইসের চালান ট্রাকে করে পাচার হচ্ছে। নৌকার সঙ্গে ইয়াবার প্যাকেট পানি-নিরোধক করে দড়ি দিয়ে বেঁধে নদীর মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, গ্যাসের সিলিন্ডার, টিভি, ফ্রিজ, সাপের বাক্স, কাঠের চেয়ার-টেবিলের ভিতরে গর্ত করে এমনকি মহিলাদের ভ্যানিটি ব্যাগ এবং মানি ব্যাগেও ইয়াবা পাচার করা হচ্ছে। কাঠের গুঁড়ির ভিতরে গর্ত করে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা ঢুকিয়ে সেই গর্ত কাঠ বা মোম দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং চিহ্নিত করার জন্য কাঠের গায়ে বিশেষ সংকেত দেওয়া হয়। মানবদেহও ইয়াবা পাচারের নিরাপদ মাধ্যম হয়ে উঠেছে। পেট, পায়ুপথ, যৌনাঙ্গ এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে স্কচটেপ দিয়ে মুড়িয়ে ইয়াবা পাচার করা হচ্ছে। টিফিন ক্যারিয়ার, পানের খাঁচা, জুতার ভিতর, টর্চলাইট ও ওষুধের প্যাকেটের মতো সাধারণ বস্তাও মাদক বহনের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। পানবোঝাই ট্রাক ও চান্দের গাড়ির মালামালের সঙ্গেও ইয়াবা মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পর্যটকের ছদ্মবেশে ব্যক্তিগত গাড়িতে করে এবং ট্রেন, বিমান ও নৌকায় ব্যাগের পাশাপাশি বিভিন্ন যন্ত্রপাতির মধ্যেও ইয়াবা পাচার করা হচ্ছে। মাদকদ্রব্যের ক্যারিয়ার হিসেবে ২২ শ্রেণি-পেশার সম্পৃক্ততা পেয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। মাদক পাচারের সঙ্গে কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা মাদক পাচারকারী ও ব্যবসায়ী, গাড়ির চালক, হেলপার, সুপারভাইজার, রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ, দরিদ্র ভাসমান নারী-পুরুষ, ওষুধ কোম্পানির কর্মী, মাঝি, ইমাম, ভান্তে, সাপুড়ে, শ্রমিক, জনপ্রতিনিধি, বিমান ও রেলের কর্মচারী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কতিপয় সদস্য, এনজিওকর্মী, ব্যবসায়ী, অর্থের বিনিময়ে নারী-পুরুষ, পরিবহন শ্রমিক এবং বিভিন্ন সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত।