দেশের কৃষিতে নতুন বিপ্লব ঘটেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ফসলের উৎপাদন ১০ কোটি টন ছাড়িয়েছে। স্বাধীনতার পর এক অর্থবছরে কৃষিতে এমন সাফল্য এর আগে দেখা যায়নি। ফসল উৎপাদনের এমন সাফল্য দেশের কৃষি গবেষণার বলে মত সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু ফসল উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত ৯০ শতাংশ কৃষক প্রান্তিক ও বর্গাচাষি। দেদার কৃষিপণ্য আমদানি ও সরকারের শস্য সহায়তা না থাকায় কৃষক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করেন তারা।
কৃষি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গবেষণার ফলে দেশের কৃষিতে যেমন সাফল্য এসেছে, তেমনি আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে আগামীতে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। এর মধ্যে বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক কৃষি বাস্তবায়ন করতে কৃষি খাতে বিনিয়োগ না আসা অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি কৃষি সম্প্রসারণে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও বীজ প্রতারণা ঠেকানো বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জানা গেছে, ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আশির দশকে জিডিপির ৫০ শতাংশ কৃষি থেকে আসত। কিন্তু গত ৫০ বছরে সরকারের শস্য সংগ্রহ পদ্ধতি কৃষকবান্ধব না হওয়ায় কৃষিকাজ কমতে থাকে। তাতে কৃষির জিডিপির হার কমে বর্তমানে ১২ শতাংশে নেমেছে। পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ায় আগ্রহ হারিয়ে পেশা ছাড়ছেন কৃষকরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের গেল তিন বছরের ফসল উৎপাদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতি বছর গড়ে ১২ শতাংশ করে ফসলের উৎপাদন বেড়েছে। এর মধ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট ফসল উৎপাদন হয়েছে ৭ কোটি ৮৫ লাখ টন। ১২ শতাংশ বেড়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট ফসল উৎপাদন ছিল ৯ কোটি ৭৫ লাখ টন। একইভাবে ১০ শতাংশ উৎপাদন বেড়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১০ কোটি ৫ লাখ টন ফসল উৎপাদন হয়েছে। যা দেশের কৃষিতে নতুন রেকর্ড গড়েছে। কৃষি অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) সাবেক মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পর্যাপ্ত গবেষণার কারণে আমরা ফসল উৎপাদনে এগিয়েছি। তবে উৎপাদনকারীদের নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে। কেননা সরকারের ফসল সংরক্ষণ ব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় দেশে প্রান্তিক খামারির সংখ্যা বেড়েছে। যখন বিশ্বের অন্যান্য দেশে কৃষকের জন্য আর্থিক ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হয়। তখন আমাদের কৃষক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে। কৃষি পেশা ছেড়ে অন্য কাজে যুক্ত হচ্ছে। এদিকে কৃষিপণ্য পর্যাপ্ত উৎপাদন হলেও আমদানির প্রবণতা বৃদ্ধি ও ফসল নিয়ে সরকারের নানা অব্যবস্থাপনার জন্য কৃষি খাত ছেড়ে যাচ্ছেন অনেক কৃষক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনশুমারি ও গৃহ গণনা ২০২২ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী ১০ বছর বা তার বেশি বয়সি নাগরিকদের ৩৭ দশমিক ৯১ শতাংশ কৃষি শ্রমিক। অথচ ২০১১ সালের আদমশুমারিতে এ হার ছিল ৪৭ দশমিক ০৩ শতাংশ। ১১ বছরে কৃষক কমেছে ৯ দশমিক ১২ শতাংশ। শুধু কৃষিতেই শ্রমিক কমেছে। পক্ষান্তরে শিল্প ও সেবা খাতে উল্লেখযোগ্য হারে শ্রমিক বেড়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আমদানি উইংয়ের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চাল আমদানি হয়েছে ৩৩৪ টন, তুলা ৬৬ লাখ ৬২ হাজার ৫৩৪ টন, ভুট্টা ১২ লাখ ২০ হাজার ৫৩ টন, মসুর ডাল ৪ লাখ ৩৩ হাজার ৮৬৫ টন ও সয়াবিন আমদানি হয়েছে ২১ লাখ ২৬ হাজার ৪০০ টন। অন্যদিকে আমদানির বিপরীতে আশঙ্কাজনক হারে কৃষিপণ্য রপ্তানি কমেছে। বাংলাদেশে গত বছরের তুলনায় কৃষিপণ্যের রপ্তানি কমেছে প্রায় ১৯ শতাংশ। সবজি, তামাক ও শুকনো খাদ্যে রপ্তানি কমেছে উদ্বেগজনক হারে। কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের কৃষিপণ্যের মার্কেট ভ্যালু ১৫ বিলিয়ন ডলারের। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্য দিয়ে ১০ বিলিয়ন ডলারের কৃষিপণ্যের চাহিদা পূরণ করা হয়। বাকি ৫ বিলিয়ন ডলার কৃষিপণ্য আমদানি করে চাহিদা পূরণ করতে হয়। কিন্তু বিপরীতে কৃষিপণ্য রপ্তানি হতে দেখা যাচ্ছে না।